নেক কাজ বলতে আমরা যা বুঝি, তা আমলের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়। আমরা মনে করি, নেক কাজ মানে আলাদা কিছু, যা মসজিদে করতে হবে, অজুর সঙ্গে পালন করতে হবে, কিংবা এক জায়গায় বসে নীরবে পালন করতে হবে। কিন্তু ব্যাপারটি সার্বিকভাবে তা নয়। ফরজ বিধান ও অল্প কিছু নফল এবং তাসবিহাত আদায়ের ক্ষেত্রে এগুলো প্রযোজ্য। বরং একজন মুমিনের পুরো জীবনটাই হতে পারে নেক আমল। আসলে নেক আমল করা যতটুকু প্রয়োজন, তার চেয়ে প্রয়োজন আমলকে নেক করা। অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি কাজকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণের নিমিত্তে সুন্নাহর নির্দেশনা অনুযাায়ী পালন করা। বস্তুত মুমিনের প্রকৃত জীবন বৃত্তান্ত তো এই যে, ‘আমার দৈহিক ইবাদত, আমার আর্থিক কর্মসম্পাদন, আমার জীবন আমার মৃত্যু- সব কিছুই রাব্বুল আলামিন আল্লাহর জন্য নিবেদিত।’
আসলে যেকোনো কাজকে বাহ্য দৃষ্টিতে বিবেচনা না করে তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করতে হবে। আমরা জানি না, কোন্ নেক কাজ, যা হয়তো দেখতে সামান্য, কিন্তু আল্লাহতায়ালার কাছে কবুল হয়ে গেলে তা জাহান্নাম থেকে নাজাতের কারণ হয়ে যাবে। এমনকি খেজুরের সামান্য অংশ দান করা- তাও হয়ে যেতে পারে নাজাতের ওসিলা। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা খেজুরের একটি অংশ দিয়ে হলেও জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা করো, আর তাও যদি না পারো তাহলে ভালো কথা দিয়ে...। -সহিহ বোখারি : ৬০২৩
হাদিসে বর্ণিত শব্দ ‘ভালো কথা’-এর ব্যাখ্যায় অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যেমন, ভালো কাজের পথ দেখানো, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখা, দুই বিবাদকারীর মাঝে সন্ধি করে দেওয়া, কোনো অস্পষ্ট বিষয়কে স্পষ্ট করা, কোনো ক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে সামলে নেওয়া কিংবা রাগান্বিত ব্যক্তিকে শান্ত করা ইত্যাদি। এই কাজগুলো আমরা স্বাভাবিকভাবেই করে থাকি। কিন্তু তাকে নেক কাজ বিবেচনা করি না। অথচ এভাবে ছোট ছোট কাজ সচেতনতার সঙ্গে সম্পন্ন করলে, তা হবে নেকির কারণ। এভাবে আমাদের দুনিয়ার জীবন হবে আমাদের আখেরাতের জন্য উত্তম প্রস্তুতি। এসব কাজ যত সামান্যই মনে হোক, আখেরাতের দীর্ঘ সফরের পথে মুমিনের জন্য তা উত্তম পাথেয়। তাই তো ইরশাদ হয়েছে, ‘যে অণু পরিমাণও নেক আমল করবে, সে তা দেখতে পাবে’ অর্থাৎ তার প্রতিদান পেয়ে যাবে।
ছোট নেকির ন্যায় ছোট গোনাহকেও আমরা অনেক সময় পরোয়া করি না। অথচ প্রতিটি গোনাহ এমন, যদি তা ক্ষমা ছাড়া রয়ে যায় তাহলে এই একটি গোনাহের জন্যও কেয়ামতের দিন হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে। সেদিন আমার কাছে এ ব্যাপারে কৈফিয়ত তলব করা হবে। যেই মহান মালিকের পক্ষ থেকে হিসাব নেওয়া হবে এবং যেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে, তখন গোনাহ কীভাবে ‘ছোট’ হয়!
তাই তো নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে উম্মতকে সতর্ক করেছেন। স্বয়ং উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রাযি.)-কে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্বোধন করে বলেন, ‘হে আয়েশা! ছোট ও তুচ্ছ ধরনের গোনাহ থেকেও সতর্ক থাকো। কেননা তুচ্ছ গোনাহের ব্যাপারেও মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হিসাব তলবকারী থাকবেন। -সুনানে দারেমি : ২৭৬৮
মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফেরেশতারা যা লিখছে, যার হিসাব সংরক্ষণ করা হচ্ছে এবং কেয়ামতের ভয়াবহ দিনে যে হিসাবের নিষ্পত্তি হবে, তা ছোট কোনো বিষয় হতে পারে না। কিন্তু কেন যেন আমরা ঘুমিয়ে থাকি। আমাদের সঠিক উপলব্ধি জাগ্রত হয় না!
এক হাদিসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘ছোট গোনাহের ব্যাপারে তোমরা সাবধান হও। কেননা মানুষের ওপর তা জমা হয়ে একপর্যায়ে তাকে ধ্বংস করে ছাড়ে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৃষ্টান্ত দিয়েছেন এভাবে যে, কিছু লোক এক প্রান্তরে যাত্রা বিরতি করল। খাবার প্রস্তুতের সময় হলে প্রত্যেকে গিয়ে কিছু লাকড়ি কুড়িয়ে আনল। এভাবে কিছু কিছু করে বহু জ্বালানী সংগ্রহ হলো। তখন তা দিয়ে বড় করে আগুন জ্বালিয়ে তারা খাবার প্রস্তুত করল।’ -মুসনাদে আহমাদ : ৩৮১৮
এই হাদিসে দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝানো হয়েছে, ছোট ছোট ইন্ধন একত্র হয়ে বিরাট অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হতে পারে। ফলে তখন তা যে কোনো কিছু জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
আসলে নেকি ও গোনাহ উপলব্ধির জন্য শুধু দৃষ্টি যথেষ্ট নয় বরং প্রয়োজন হয় অন্তর্দৃষ্টি। কিন্তু বনি আদমের আখেরাতবিমুখতা অন্তর্দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আর অন্তর্দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে গেলে বাহ্যদৃষ্টিও আর কল্যাণের পথ দেখায় না...। আখেরাতের পথে যারা চলেছেন, চলছেন; তাদের সঙ্গই পারে মানুষের সঠিক দৃষ্টি এবং অন্তর্দৃষ্টি জাগ্রত করতে।