মসজিদ আল্লাহর ঘর। ‘বায়তুল্লাহ’ তথা আল্লাহর পবিত্র ঘর হিসেবে যাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তা পৃথিবীতে মানবেতিহাসের প্রথম গৃহ হিসেবে পরিচিত। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে বিশ্বমানবতার জন্য নির্মিত প্রথম গৃহ যেটি পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত এবং এই গৃহ হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীর জন্য বরকতমণ্ডিত ও সঠিক পথনির্দেশনার অনন্য নিদর্শন।’ সেই পবিত্র গৃহটির নামই হচ্ছে- কাবা শরিফ। পবিত্র কাবার অবস্থান ও মর্যাদা সম্বন্ধে নাজিলকৃত এ আয়াতে কারিমায় মহিমান্বিত এ গৃহের তাৎপর্য ও কার্যকারিতা স্পষ্টভাবেই বিবৃত হয়েছে; যাতে কাবা শরিফ নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ও কর্মপরিধি বিষয়ে আমরা সম্যক অবহিত হতে পারি।
পৃথিবীর সব মসজিদই পবিত্র কাবার অনুসরণে ও একই কার্যপ্রণালির আওতায় প্রতিষ্ঠা করা হয়। অর্থাৎ মহামহিম প্রভুর ইবাদতের জন্যই মসজিদের সৃষ্টি; পরম স্রষ্টার সুনির্ধারিত অন্যতম হুকুম নামাজ আদায়সহ নানাবিধ ইবাদতের মাধ্যমে আবাদ করাটাই বান্দার কাছে মসজিদের চাওয়া।
‘মসজিদ’ মানে সেজদার জায়গা; যেখানে মহান রবের উদ্দেশে তারই সন্তুষ্টি বিধানের জন্য তাকে ভক্তিভরে সেজদা করা হয় সেটিই মসজিদ। সে অর্থে উম্মতে মোহাম্মদির জন্য গোটা জমিনটাকেই মহান আল্লাহ মসজিদরূপে ছাড়পত্র দিয়েছেন; আর এটি নিঃসন্দেহে তারই প্রেরিত রাসুল (সা.)-এর বরকত! কবির ভাষায়, ‘বিশ্বমানবতার করুণার মূর্তপ্রতীক মহানবী (সা.)-এর শুভাগমনের ফলে মহান আল্লাহ সমগ্র ভূমণ্ডলকেই মসজিদে পরিণত করেছেন।’
দুনিয়ার মুসলমানরা যখনই নামাজের সময় হবে পবিত্র জমিন দেখে সেখানেই নামাজ আদায় করে নিতে পারবে। তার পরেও সুনির্দিষ্ট স্থাপত্য-কাঠামোর আঙ্গিকে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। আর সেই নির্মিত স্থাপনা শুধু নামাজ আদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং মসজিদ থেকেই সমাজ সংস্কারের নানা কর্মসূচি প্রণীত ও বাস্তবায়িত হয়। বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অসংখ্য মসজিদ। আজ এমনই তিনটি মসজিদ নিয়ে আলোচনা করা হলো-
খলিফা আল তাজির মসজিদ, দুবাই
এটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দেইরাতে অবস্থিত মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম পরিবেশবান্ধব মসজিদ। দুবাইয়ের বন্দর সাঈদ এলাকায় স্থাপিত এই মসজিদ ২০১৪ সালে নামমাজের জন্য খুলে দেওয়া হয়। খলিফা আল তাজির এই মসজিদ নির্মাণের জন্য ২০ মিলিয়ন দিনার দান করেন। তার নামানুসারেই মসজিদটির নামকরণ করা হয়। ৪৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে নির্মিত এই মসজিদে তিন হাজার ৫০০ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।
দ্বিতলবিশিষ্ট মসজিদটিতে নারীদেরসহ তিনটি নামাজের স্থান আছে। এখানে ৬০০ নারী একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন। তা ছাড়া মসজিদ এলাকায় ইমাম, মোয়াজ্জিন ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য আলাদা আবাসন ব্যবস্থাও করা হয়েছে। মসজিদের বাইরে বিশাল কার পার্কিং ও উন্মুক্ত সবুজ চত্বর মসজিদের শোভাকে বৃদ্ধি করেছে। আল তাজির মসজিদের দু’টি মিনারের প্রতিটির উচ্চতা ২৫ মিটার। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখানে পানি ও বিদ্যুৎ ব্যবহার যথাক্রমে ২০ ও ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনা হয়েছে। এ জন্য মসজিদে লাগানো হয়েছে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী এলইডি বাতি ও সোলার প্যানেল। দিনে স্বাভাবিক আলোর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য মসজিদের সব জায়গায় ‘ডেলাইট সেন্সর’ বসানো হয়েছে। সব মিলে এটি একটি সর্বাধুনিক আদর্শ মসজিদ।
মসজিদ আল জিকরা, ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম জাভা প্রদেশের পাহাড়ি শহর সেনটুলে আল জিকরা মসজিদ অবস্থিত। এই মসজিদের বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা, পানি সংরক্ষণ, নির্মাণসামগ্রী, ভবনের অভ্যন্তরস্থ স্বাস্থ্য পরিবেশ সবই পরিবেশবান্ধব কৌশলে স্থাপিত হয়েছে। মসজিদটির উচ্চতা ও বায়ুচলাচল ব্যবস্থার কারণে সতেজ বায়ু সহজে ভেতরে প্রবেশ করে এবং আলো ও শীতাতপের জন্য বিদ্যুৎ খরচ কম হয়। মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- পানির পুনর্ব্যবহারোপযোগী ব্যবস্থা। এতে পানির অপচয় যেমন কমেছে, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারও হ্রাস পেয়েছে।
মসজিদের বাইরে ৪০ শতাংশ এলাকা উন্মুক্ত এবং সবুজ ঘাসে ঢাকা। এতে মসজিদের শোভা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি পরিবেশ দূষণ কমেছে অনেকাংশে। পরিবেশবান্ধব এই মসজিদের উদ্যোক্তা হাইউ প্রাভোউ। মসজিদটি নির্মাণের পর ২০১৭ সালে নামাজের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এর উদ্বোধনকালে ইন্দোনেশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট দেশে ২০২০ সালের মধ্যে আরও এক হাজার পরিবেশবান্ধব মসজিদ নির্মাণের আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন এবং সেগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
ডিজনি বড় মসজিদ, মালি
মালির ডিজনি মসজিদ আফ্রিকার একটি বিস্ময়। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বৃহত্তম মাটির তৈরি মসজিদ। মসজিদটি মাটি ও গাছের ডাল দিয়ে নির্মিত। এটি হাতে তৈরি মাটির মসজিদ হওয়ায় পরিবেশ দূষণের পরিমাণ এখানে প্রায় শূন্য। স্বল্প ব্যয়ে নির্মিত ১০ ফুট উচ্চতার এই মসজিদের ভিত্তি মাটির তৈরি। মসজিদের দেয়াল মাটি, বালু, ধানের তুষ এবং পানির মিশ্রণে তৈরি ইট দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এরপর এতে সেঁটে দেওয়া হয়েছে কাঠ। মসজিদে তিনটি মিনার আছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ডিজনি বড় মসজিদটি তিনবারে নির্মিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। ডিজনির ২৬তম মুসলিম শাসক কওই কুনবরো ১৩ শতকে প্রথমবার এই মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটি একটি নদীর তীরে অবস্থিত। ষোলো শতকে এক প্রলয়ঙ্করী বন্যায় ডিজনি শহরসহ বড় মসজিদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। তখন মসজিদটি দ্বিতীয়বারের মতো পুনর্নির্মাণ করা হয়। তৃতীয়বার বর্তমান মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯০৭ সালে।
কেমব্রিজ কেন্দ্রীয় মসজিদ, যুক্তরাজ্য
এটি যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় পরিবেশবান্ধব মসজিদ। কেমব্রিজ শহরের রোমসি এলাকার মিল রোডে স্থাপিত এই মসজিদ ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল জনসাধারণের নামাজের জন্য খুলে দেওয়া হয়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের লেকচারার ড. টিমোথি উন্টার ২০০৮ সালে এই মসজিদ প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং এর জন্য তহবিল জোগাড় করার চেষ্টা চালান। ২০০৯ সালে চার মিলিয়ন ইউরো খরচ করে মসজিদের জন্য এক একর জায়গা ক্রয় করা হয়।
স্থাপত্য প্রকৌশলী মার্কস বারফিল্ড, প্রফেসর কেইথ ক্রিটিচলো এবং প্রখ্যাত ইসলামিক গার্ডেন ডিজাইনার ইমমা ক্লার্ক মিলে মসজিদের ডিজাইন তৈরি করেন। অপূর্ব সুন্দর এই মসজিদে এক হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন। তা ছাড়া মসজিদে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের জন্য আলাদা একটি জায়গা আছে। রয়েছে শিশুদের খেলাধুলার ব্যবস্থা। মসজিদে স্থাপন করা হয়েছে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী এবং অন্যান্য শক্তি ক্ষয়রোধক ব্যবস্থা। এলইডি বাতিসহ মসজিদের ছাদে বৃষ্টির পানির জলাধার এবং পানির পুনর্ব্যবহারোপযোগী প্রযুক্তিও এতে সংযুক্ত হয়েছে। এর অনবদ্য নির্মাণশৈলীর কারণে বছরজুড়ে সূর্যের আলো মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। সব মিলিয়ে এটি ইউরোপের একটি বিরল পরিবেশবান্ধব মসজিদ। প্রতিনিয়ত অনেক পর্যটক এই অসাধারণ মসজিদটি দেখার জন্য ভিড় করেন।