ইতিহাস-ঐতিহ্যের শহর বলে খ্যাত ময়মনসিংহ। এই শহরে ইতিহাসের অন্যতম নিদর্শন হয়ে আছে বড় মসজিদ। ময়মনসিংহের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে লেখা বিভিন্ন গ্রন্থে বড় মসজিদের কথা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। ময়মনসিংহে নগর সভ্যতার বিকাশে স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান সমাজের সহাবস্থান ছিল, বড় মসজিদের অবস্থান তার ঐতিহাসিক দলিল। মসজিদের পাশে থানা ও একটি মন্দির আছে। রয়েছে একটি কবরস্থানও। বড় মসজিদ ময়মনসিংহ বিভাগের কেন্দ্রীয় দ্বীনি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত।
হজরত শাহজালাল রহমাতু্ল্লাহি আলাইহির আগমনের ২৫০ বছর আগে শাহ মুহাম্মদ সুলতান কমরউদ্দিন রুমি (রহ.) বৃহত্তর ময়মনসিংহে ইসলাম প্রচার করেন। বাংলার স্বাধীন সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পুত্র সৈয়দ নাসিরুদ্দিন নসরত শাহের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘নাসিরাবাদ’কে কেন্দ্র করে আদি ময়মনসিংহের গোড়াপত্তন। পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের তীরে ১ মে ১৭৮৭ প্রতিষ্ঠিত ময়মনসিংহ জেলা, এখন বিভাগীয় মহানগরী। ‘আইন-ই-আকবরি’ অনুযায়ী, ‘মোমেনশাহী পরগনার শাসনকর্তা মোমেনশাহের নামানুসারে পরগনার নাম হয় মোমেনশাহী।’ পরবর্তী সময়ে আলাপসিং পরগনার ‘সিংহ’ যুক্ত হয়ে উচ্চারণ পরিবর্তনে হয় ময়মনসিংহ’ (ইসলামি বিশ্বকোষ)।
বৃহত্তর ময়মনসিংহের কেন্দ্রীয় মসজিদ চকবাজারের ‘বড় মসজিদ’। ঈদ, জুমায় অসংখ্য মানুষ বাস-ট্রেনে চড়ে, হেঁটে বহুদূর থেকে আসেন ‘বড় মসজিদে’র বরকত নেওয়ার জন্য।
বর্তমান কোতোয়ালি থানাসংলগ্ন চকবাজার নামক স্থানে আনুমানিক পৌনে দুই শ’ বছর আগে (১৮৫০/১৮৫২ খ্রি.) গণ্যমান্য মুসলমানরা নামাজ আদায়ের জন্য টিনের ছাপরা মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদটিই ময়মনসিংহের গর্ব ও ঐতিহ্যের স্মারক ‘বড় মসজিদ’। ১৯৩৫ সালের বেঙ্গল ওয়াকফ অ্যাক্টের অধীনে মসজিদটি পাবলিক এস্টেটে পরিণত হয়।
প্রায় ০১.৯ একর জমির ওপর নির্মিত ‘বড় মসজিদ’ একটি তিনতলা সুরম্য স্থাপত্য। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১০৫ ফুট ও প্রস্থ ৮৫ ফুট। অন্তত পাঁচ হাজার মুসল্লি এখানে একত্রে নামাজ আদায় করতে পারে। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সুসমন্বয়ে অপূর্ব অলংকরণে সুশোভিত মসজিদের ১২৫ ফুট উঁচু দুটি মিনার ও একটি কেন্দ্রীয় সুবৃহৎ গম্বুজে ব্যবহৃত হয়েছে চীনামাটির তৈজসপত্রের টুকরা দিয়ে তৈরি নান্দনিক নকশাকৃত আস্তরণ। মসজিদের পশ্চিম দিকে রয়েছে দুটি অনুচ্চ ফাঁপা গম্বুজ। ছাদের রেলিং দেওয়া হয়েছে মিনার-গম্বুজের আদলে ঢেউ খেলানো শোভায়। মসজিদের প্রধান তিনটি প্রবেশমুখেও আছে অনুচ্চ গম্বুজ শোভিত ফটক। মসজিদ আঙিনা অলংকৃত হয়েছে আরও কয়েকটি বৃহদাকৃতির অনুচ্চ গম্বুজ ও লতাপাতার বিন্যস্ততায় থোকায় থোকায় আঙুর শোভিত ফটক ও অনুচ্চ নকশা দেয়ালে।
মসজিদের প্রবেশমুখেই, জলকেলিরত রংবেরঙের মাছের শোভামণ্ডিত স্বচ্ছ-পবিত্র পানির দু’টি হাউস ও আলাদা অজুখানা। মসজিদের অভ্যন্তরে মূল্যবান মোজাইক পাথরের মেঝে, দেয়ালজুড়ে শেতশুভ্র মনোরম টাইলস, সুদৃশ্য ঝাড়বাতি, অত্যাধুনিক শব্দ নিয়ন্ত্রণ ও তাপানুকূল ব্যবস্থা। পবিত্র রমজানে অসংখ্য মুসল্লি জামাতবদ্ধভাবে এই মসজিদে ইতিকাফ করেন।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৪০ খ্রি. পর্যন্ত মিসর থেকে আগত প্রখ্যাত কারি ও আলেম মাওলানা আবদুল আওয়াল (রহ.) ইমামের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৯৭ খ্রি. পর্যন্ত টানা ৫৬ বছর হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবি (রহ)-এর খলিফা, মুজাদ্দিদে মিল্লাত, জামানার কুতুব হজরত মাওলানা ফয়জুর রহমান (রহ.) ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। এ মহান আধ্যাত্মিক সাধকের পবিত্র ফায়েজ, খেদমত ও মেহনতে ‘বড় মসজিদে’র দ্যুতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৯৭ খ্রি. থেকে হাদিয়ে জামান, পীরে কামেল, আল্লামা শায়খ আবদুল হক অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন।
বড় মসজিদে রয়েছে মসজিদকেন্দ্রিক একটি মাদরাসা। ব্রহ্মপুত্র নদ তীরবর্তী ময়মনসিংহ সিটি করর্পোরেশনের প্রাণকেন্দ্রে বড় মসজিদ যুগ যুগ ধরে ময়মনসিংহের অন্যতম ধর্মীয় স্মারক হয়ে আছে।