কলকাতার নাখোদা মসজিদ। ভারতের বাংলাভাষী মুসলমানদের সর্ববৃহৎ উপাসনালয়। মোগল সম্রাট আকবরের সমাধির আদলে লাল বেলে পাথর আর আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে তৈরি এই মসজিদই অবিভক্ত বাংলার সবচেয়ে বড় মসজিদ ছিল।
১৯২৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিটের সংযোগস্থলে নির্মাণকাজ শুরু হয় এই মসজিদের। কচ্ছের মেনন সম্প্রদায়ের নেতা সমুদ্র বণিক আবদুর রহমান ওসমান নিজের উপার্জিত অর্থ থেকে তৎকালীন সময়ে ১৫ লাখ টাকা নির্মাণ খরচ বহন করেছিলেন এই মসজিদের জন্য, যার বর্তমান বাজারমূল্য কয়েক শ’ কোটি টাকার মতো।
মেনন সম্প্রদায় কলকাতায় বসবাস শুরু করে ১৮২০ সালের দিকে। তারা বেশিরভাগ জাহাজ, চিনি ও অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিশেষ প্রতিপত্তি ও বিপুল বিত্তশালী হয়ে ওঠেন। দিনে দিনে তারা কলকাতা শহরের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তিল তিল করে গড়ে তোলেন আধুনিক কলকাতার নানা রূপ-বৈচিত্র্য। তাদের অবদানেরই সাক্ষী এই নাখোদা মসজিদ।
ফারসি ভাষায় নাখোদা শব্দের অর্থ জাহাজের নাবিক বা যিনি জাহাজযোগে মালপত্র আমদানি-রপ্তানির কাজ করেন। আবদুর রহমান ওসমান সমুদ্রসংশ্লিষ্ট কর্ম ও বাণিজ্যে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাই তারই নামানুসারে এই মসজিদের নামকরণ হয় নাখোদা মসজিদ।
১০০ ফুট উচ্চতার ২৫টি ছোট মিনার, ১৫০ ফুট উচ্চতার দু’টি বড় মিনারসহ দুর্লভ গ্রানাইট পাথর দিয়ে নির্মিত সুবিশাল দ্বিতল চাতালে সজ্জিত হয়েছে এই মসজিদ। মূল ভবনে একসঙ্গে ১৫ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারে। ঈদের দিনে চাতালগুলোর ভরপুর সমাগমে লাখের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায়।
মুসলমানদের হাতে তিলে তিলে গড়ে ওঠা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী আধুনিক কলকাতার অনন্য শৈল্পিক স্থাপত্য এই নাখোদা মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৪২ সালে। তৎকালীন সময়ের সর্ববৃহৎ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ম্যাকিনটোশ বার্ন কোম্পানি বিহারের তোলেপুর থেকে গ্রানাইট পাথর এনে ইন্দো-সেরাসেনিক পদ্ধতিতে সম্পাদন করে এই সুবিশাল নির্মাণযজ্ঞ। শ্বেতপাথরে গড়া মসজিদের ভেতরের অংশ তাজমহলের কথা মনে করিয়ে দেয়। মসজিদের প্রধান ফটক বানানো হয়েছে মোগল সম্রাট আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত ফতেপুর সিক্রির বুলন্দ দরওয়াজার আদলে।
নাখোদা মসজিদ স্থাপত্যের দিক থেকে এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। সূক্ষ্ম অলংকরণ, শৈল্পিক কল্পনার এক অনন্য নিদর্শন। সাদা মার্বেলের দেয়াল, বেলজিয়াম কাচ, বিশাল নামাজের জায়গা, দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো কাঠের ঘড়ি। এ যেন দেয়ালের ভাঁজে ভাঁজে মুসলিম ঐতিহ্য ও ইতিহাসের গন্ধ। মসজিদের মেঝে, দেয়াল ও গগনছোঁয়া মিনারগুলো যেন মাথা উঁচু করে আধুনিক ভারত বিনির্মাণে মুসলিম কৃতিত্ব আর অবদানের ঘোষণা দিচ্ছে।
ভারত সরকার ২০০৮ সালে মসজিদটিকে হেরিটেজ বিল্ডিং বা ঐতিহ্যবাহী ভবনের মর্যাদা দিয়েছে। বর্তমানে এটি শুধু মুসলমানদের উপাসনালয়ই নয়, পর্যটকদের কাছেও এটি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এই মসজিদকে কেন্দ্র করে আশপাশে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি অনন্য মার্কেট। সেগুলোতে এমন কিছু পণ্য বেচাকেনা হয়, যা সাধারণত অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। অনেকেই বলেন, নাখোদা মসজিদ লাগোয়া চিৎপুর রোডের প্রতিটা কোণে কোণে পাওয়া যায় বাদশাহি মেজাজ৷ সুতোর কাজ করা জামাকাপড় থেকে শুরু করে সুরামা, আতর, অম্বুরি তামাক, মোগলাই খানা– যেন সময় থমকে আছে৷
কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ধর্মতলার মোড়ের উত্তর পাশ ঘেঁষে নির্মিত মসজিদটি পরিচিত মহীশূরের নবাব টিপু সুলতানের মসজিদ নামে, যেটি ১৮৪২ সালে বানিয়েছিলেন টিপুর ছোট ছেলে গোলাম মুহাম্মদ শাহ। ছোট বড় মিলিয়ে দশটি মিনার আছে মসজিদের মূল গম্বুজকে ঘিরে। গম্বুজের প্রাচীন কারুকাজ এখনও অটুট।
টিপু সুলতানের ছোট ছেলে গোলাম মহম্মদ শাহ যেখানে নির্বাসিত জীবন কাটাতেন, দক্ষিণ কলকাতার সেই টালিগঞ্জেও একটি মসজিদ বানিয়েছিলেন৷ সৌন্দর্যে এবং ঐতিহাসিকভাবেও সেটি গুরুত্বপূর্ণ৷ পুরোনো মসজিদগুলো ছাড়াও কলকাতা শহরে বেশ কিছু নতুন মসজিদ তৈরি হয়েছে, যেগুলো স্থাপত্যরীতিতে একেবারেই আধুনিক৷ এভাবেই কলকাতার নাখোদা মসজিদসহ মুসলিম স্থাপনাগুলো আধুনিক ভারত বিনির্মাণে মুসলমানদের অবদানের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।