আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ হেরাতে অবস্থিত বিখ্যাত হেরাত গ্র্যান্ড মসজিদ। এই মসজিদকে আফগানিস্তানের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও শিল্প তুলে ধরার এক অনন্য নজির হিসেবে উল্লেখ করা যায়। ইতিহাসে এসেছে, এই মসজিদের স্থানে অতীতে অ্যারিয়ানদের উপাসনালয় ছিল। জরাস্ট্রিয়ানরা এখানে অগ্নিমন্দির নির্মাণ করে আগুনের উপাসনা করত। হেরাতের জনগণ ইসলাম গ্রহণের পর ২৯ হিজরিতে অগ্নিমন্দিরকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়।
হেরাত জামে মসজিদে আফগান কারুকার্যময় শিল্পের চমৎকার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। একসঙ্গে এক লাখ মুসল্লি এখানে জামাতে নামাজ আদায় করতে পারেন। বিশাল এলাকাজুড়ে নির্মিত এই মসজিদে রয়েছে ৪৬০টি গম্বুজ, ১২টি মিনার, ৪৪৪টি স্তম্ভ, ১৩০টি ছোটবড় ছাদযুক্ত বারান্দা এবং কোরআনে কারিমের আয়াতখচিত চারটি বিশাল শিলালিপি।
মসজিদের মিম্বরটি একখণ্ড বড় পাথর খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে। হেরাত জামে মসজিদে রয়েছে একটি বিশাল অজুখানা, চার হাজার বইসমৃদ্ধ একটি পাঠাগার এবং একটি মাদরাসা। এই মসজিদ নির্মাণে ইট, চুনাপাথর ও টাইলসসহ ঐতিহাসিক স্থাপনা নির্মাণের সমস্ত উপাদান ও কলাকৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। মসজিদটির সৌন্দর্য চোখে না দেখলে বর্ণনা করে বোঝানো কঠিন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে পুরো মসজিদ তৈরি না হয়ে যুগে যুগে এর এক একটি অংশ নির্মিত হয়েছে বলে নানা যুগের স্থাপত্যশৈলী এখানে চোখে পড়ে। ঘোরী শাসনামল থেকে শুরু করে তৈমুরি শাসন হয়ে পরবর্তী নানা শাসকের শিল্পকর্ম ও স্থাপত্যশৈলী এই মসজিদে দেখতে পাওয়া যায়। শত শত বছর আগে নির্মিত মসজিদটি প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত ও পুনর্নির্মিত হয়েছে।
৪১৪ হিজরিতে তখনকার কাঠনির্মিত মসজিদটির অর্ধেকটা আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। জনগণের সহযোগিতা নিয়ে খাজা মোহাম্মাদ তাকি তখনকার মতো মসজিদটি মেরামত করেন। ওই ঘটনার প্রায় দুইশ’ বছর পর ফখরুদ্দিন রাজির প্রস্তাবনায় সুলতান গিয়াসুদ্দিন ঘোরী মসজিদটির পুনর্নিমাণের নির্দেশ দেন। তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যবিদ ও নির্মাণশিল্পীদের দিয়ে হেরাত জামে মসজিদ তৈরি হয়।
পরবর্তীতে হেরাতে চেঙ্গিস খানের হামলায় মসজিদটির অপূরণীয় ক্ষতি হয়। ৭০৭ হিজরিতে তৎকালীন সুলতান গিয়াসুদ্দিন কুর্তের নির্দেশে মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করা হয় এবং এরসঙ্গে ‘গিয়াসিয়াহ’ নামে একটি মাদরাসা স্থাপন করা হয়। পাশাপাশি মসজিদে স্থাপন করা হয় ব্রোঞ্জ-নির্মিত একটি বিশাল পাত্র। চমৎকার কারুকার্যখচিত এই পাত্রে অতীতে ধর্মীয় উৎসবের দিনগুলোতে শরবত তৈরি করে হাজার হাজার মানুষের মাঝে বিতরণ করা হতো। চার দশমিক ছয় মিটার ব্যাসের পাত্রটির গভীরতা প্রায় দেড় মিটার।
হেরাত জামে মসজিদের আশপাশের মুসল্লিদের কানে আজান পৌঁছে দেওয়ার জন্য মসজিদটিতে যেসব মিনার সংযোজন করা হয় সেগুলোর উচ্চতা ১৭ থেকে ৩৬ মিটার পর্যন্ত। এসব মিনারের ব্যাস ৭ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত এবং এগুলোর প্রত্যেকটির ভেতর দিয়ে মিনারের শীর্ষে ওঠার সিঁড়ি রয়েছে। দশম হিজরিতে সুলতান হোসেইন বাইকারার শাসনামলে হেরাত জামে মসজিদ আরেকবার সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করা হয়।
১৯৪৩ সালে আফগানিস্তানের শেষ বাদশাহ মোহাম্মাদ জহির খানের নির্দেশে তৎকালীন সেরা স্থাপত্যবিদ আব্দুল্লাহ খান মেলকিয়ারের তত্ত্বাবধানে সর্বশেষবারের মতো এই মসজিদের সার্বিক সংস্কার করা হয়। মেলকিয়ার এমন একদল স্থাপত্যশিল্পীকে এই কাজে নিয়োজিত করেন যাদের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যশৈলীতে দখল রয়েছে। এসব শিল্পী নিপুণ হাতে মসজিদের অতীত স্থাপত্যরীতি অক্ষুণ্ন রেখে এটির আধুনিকায়ন করেন।
বিস্ময়ের কথা হলো, ঐতিহাসিক এই মসজিদটির সংস্কার ও মেরামত কাজ এখনও অব্যাহত রয়েছে। হেরাতের মানুষের মধ্যে জনশ্রুতি রয়েছে, এই মসজিদের নির্মাণ কাজ কোনোদিন শেষ হবে না; যদি কোনোদিন শেষ হয়ে যায় সেদিন কেয়ামত সংঘটিত হবে।
মসজিদটিকে ইউনেসকোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, আফগানিস্তানে ঔপনিবেশিক শাসনের পর ঐতিহাসিক কোনো মসজিদ অক্ষত ছিল না। ১৯৪৫ সালে বিধ্বস্ত স্থাপনাগুলো পুনর্নির্মাণের একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। তখন মসজিদের উত্তর-পশ্চিমাংশ ১০১-১২১ মিটার পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়।