আন্দোলন ঠেকাতে দীর্ঘ দিন যাবত বন্ধ ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগর জামে মসজিদ। স্থানীয় মুসলমানদের দাবি সত্ত্বেও, তা নামাজের খুলে না দেওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে। ঐতিহাসিক এই মসজিদ শ্রীনগরবাসীর গর্বের বিষয়। কিন্তু দীর্ঘ দিন যাবত মসজিদের দরোজা তালাবদ্ধ।
শ্রীনগরের জামে মসজিদটি এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ মসজিদ। একতলা মসজিদটি দেখতে অনেকটা রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের মতো। এর নির্মাণশৈলী যেকোনো দর্শনার্থীর নজর কাড়ে। ১৩৯৪ সালে সুলতান শিকান্দার শাহ সাইয়্যেদুল আউলিয়া সাইয়্যেদ আলী হামদানির ছেলে মীর মোহাম্মাদ হামাদানির নির্দেশে মসজিদটি নির্মাণ করেন। মূল মসজিদ, মসজিদের আঙিনাসহ আশপাশ এলাকা মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ লোক এখানে নামাজ আদায় করতে পারেন। লাইলাতুল কদর, ঈদের জামাত ও অন্যান্য বিশেষ দিনে মুসল্লিদের ভিড় দেখা যায় বেশি।
মসজিদের মোট পরিধি ১ লাখ ৪৬ হাজার বর্গফুট। মসজিদের ভেতরে রয়েছে ৩৭৮টি সম্পূর্ণ গাছের পিলার, যার মধ্যে ২১ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট পিলার ৩৪৬টি। আর ৪৮ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট পিলার রয়েছে ৩২টি। শহরের শতকরা ৯৬ ভাগ মুসলিম হলেও নানা কারণে বন্ধ রাখা হয়েছে ঐতিহাসিক এ মসজিদ।
প্রতি শুক্রবার কাশ্মীরের মুসলিমরা এ মসজিদে এসে জুমার নামাজ পড়তে সমবেত হন। শুধু তাই নয়, যেকোনো রাজনৈতিক অধিকারের আন্দোলনে এ মসজিদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। অনেক সময় উত্তেজনা, শঙ্কা ও ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাই দুই বছরের অধিকাংশ সময় ধরে এ মসজিদ বন্ধ।
এ দীর্ঘ সময় বিরতিহীনভাবে মসজিদের প্রধান ইমামকে ঘরবন্দী করে রাখা হয়। যেন তিনি মসজিদে প্রবেশ করতে না পারেন। পাশাপাশি মুসল্লিদের প্রবেশে বন্ধ রাখতে মসজিদের প্রধান ফটক তালাবদ্ধ থাকে। টিন দিয়ে চারপাশ ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। শুক্রবার জুমার নামাজ আদায়েও বাধা দেওয়া হয় মুসল্লিদের। শুধুমাত্র সপ্তাহের অন্যদিনগুলোতে নামাজ পড়া যায়। তবে অন্য সময়ের তুলনায় সেখানে খুবই অল্প কয়েকজন মুসল্লি নামাজ পড়তে আসেন। সেই সংখ্যা একেবারেই কম।
দীর্ঘকাল বন্ধ থাকায় ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের অধিকাংশ মুসলিমের মধ্যে তৈরি হয়েছে গভীর ক্ষোভ। গত ৫০ বছর যাবত এ মসজিদে নামাজ পড়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা বাশির আহমদ (৬৫)। তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে অতি সূক্ষ্ম কিছুর অনুপস্থিতি সর্বদা অনুভব করছি।’
যুক্তরাষ্ট্রের বার্তা সংস্থা এসোসিয়েট প্রেসের পক্ষ থেকে বন্ধ রাখার কারণ সম্পর্কে কয়েক বার জানতে চাইলেও কিছুই জানায়নি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। অবশ্য আগে কর্মকর্তারা বলতেন যে সরকার বাধ্য হয়ে মসজিদ বন্ধ রেখেছেন; কারণ মসজিদের পরিচালনা কমিটি এখানকার ভারতবিরোধী আন্দোলন বন্ধ করতে সক্ষম নন।
গত দুই বছর ধরে কাশ্মীরের অনেক মসজিদ ও মাজার নিরাপত্তাজনিত কারণে বন্ধ ছিল। এছাড়া করোনা মহামারিকালের লকডাউনেও কয়েক মাস বন্ধ থাকে এসব প্রতিষ্ঠানের সব কার্যক্রম। মূলত ২০১৯ সালে ভারত-শাসিত কাশ্মীর থেকে দীর্ঘকালের আধা-স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা বিলুপ্তির পর মসজিদটি বন্ধ রাখা হয়।
মসজিদ বন্ধের দুঃসহ স্মৃতি অতীতেও কাঁদিয়েছে কাশ্মীরিদের। ১৮১৯ সালে শিখ শাসকরা দীর্ঘ ২১ বছর ধরে ঐতিহাসিক এ মসজিদ বন্ধ রেখেছিল। গত ১৫ বছরে ভারত সরকারের পর্যায়ক্রমিক নিষেধাজ্ঞা ও লকডাউনে অনেক দিন পর্যন্ত বন্ধ থাকে এ মসজিদ। কিন্তু বর্তমানের নিষেধাজ্ঞা ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর সবচেয়ে গুরুতর বলে মনে করছেন অনেকে। সরকারি তথ্য অনুসারে ২০০৮, ২০১০ ও ২০১৬ সালে সব মিলিয়ে ২৫০ দিন পর্যন্ত মসজিদটি বন্ধ ছিল।
গ্র্যান্ড মসজিদের কর্মকর্তা আলতাফ আহমদ ভাট জানান, মানুষ এ মসজিদে এসে ধ্যান করত, আধ্যাত্মিকতা অনুভব করব। এখানকার মিরেওয়ায়েজ পদ্ধতি খুতবা প্রদানের একটি অনন্য রীতি। সামাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতি বিষয়ক আলোচনাই ছিল এ মসজিদের মূল ধর্মীয় কাজ। আমি মনে করি, তারা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে না পারলে এটি তাদের অযোগ্যতা। আমরা এখানে আমাদের আওয়াজ তুলেছি। আর তা সবসময় রাজনৈতিক কারণে হয় না। আমি মনে করি, এটি কোনও যুক্তি নয়।