দিন দিন বিশ্ব বাণিজ্যে হালাল অর্থনীতির পরিধি বাড়ছে। বিষয়টি আর অনুমান নির্ভর কিংবা জাগরণী কোনো মন্তব্য নয়। সম্প্রতি যৌথভাবে আয়োজিত অষ্টম ওআইসি এবং সপ্তম বিশ্ব হালাল শীর্ষ সম্মেলনের সময় তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতে এ কথা জানিয়েছেন।
সম্মেলনের তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে হালাল অর্থনীতি ছিল ৪০ লাখ কোটি ডলারের। এখন তা ৭০ লাখ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। হালাল অর্থনীতির যে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে, বলা বাহুল্য, এটা তারই প্রমাণ বহন করে। ফুয়াত ওকতে উল্লেখ করেছেন, শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ২০টির বেশি দেশ এবং ৩৫টি দেশের চারশটি কোম্পানির পক্ষ থেকে (যারা খাদ্য, প্রসাধনী, ওষুধ, টেক্সটাইল, পর্যটন প্রভৃতি খাতে কাজ করছে) এই মর্মে আশ্বস্থ করা হয়েছে যে, তারা করোনা মহামারি সত্ত্বেও হালাল পণ্য ও পরিষেবা চালিয়ে যাবে।
ইসলামের হালাল-হারাম বিধান অনুযায়ী হালাল খাদ্য, হালাল পণ্য, হালাল পর্যটন, হালাল অর্থনীতি ইত্যাদির ভিত্তি গড়ে উঠেছে। হালাল খাদ্য বা পণ্য মানবস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক থেকেও তুলনামূলকভাবে অধিকতর স্বাস্থ্যসম্মত। এ কারণে মুসলমানরা তো বটেই, অমুসলিমরাও অনেকে হালাল খাদ্য ও পণ্যের অনুরাগী ও ভক্ত। এর জনপ্রিয়তা বিশ্বজুড়েই বাড়ছে। হালাল খাদ্য, পণ্য ও পরিবেশের অভাবে মুসলিম বিশ্বের অনেকে পর্যটনে অনাগ্রহী ছিল। এখন মুসলিম দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হালাল খাদ্য, পণ্য ও পরিবেশের নিশ্চয়তা থাকায় মুসলিম পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ছে। তুরস্ক হালাল খাদ্য, পণ্য ও শরীয়তসম্মত পরিবেশের ব্যবস্থা করায় সেখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতোমধ্যে সে দেশের অর্থনীতির অপরিহার্য উৎসে পরিণত হয়েছে পর্যটনশিল্প। অন্যান্য মুসলিম দেশ বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এ ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে গেছে।
বিশ্বে এখন প্রায় দু’শ কোটি মুসলমানের বাস। হালাল খাদ্য ও পণ্য তারা তো চাইবেই। অমুসলিমদের একটা বড় অংশ হালাল খাদ্য ও পণ্য পছন্দ করে। এ থেকে হালাল খাদ্য ও পণ্যের চাহিদা এবং বাজারের পরিধি কতটা বড়, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। হালাল অর্থনীতির অপার সম্ভাবনার কথাও উপলব্ধি করা যায়। হালাল খাদ্য ও পণ্যের উৎপাদন, রফতানি, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলোর এগিয়ে থাকা স্বাভাবিক মনে হলেও তারা পিছিয়ে আছে। বর্তমানে হালাল খাদ্য ও পণ্য উৎপাদন ও রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে প্রথমেই ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, নিউজিল্যান্ডের কথা উল্লেখ করা যায়, যারা অমুসলিম দেশ হিসাবে পরিচিত। তারা বাণিজ্য বৃদ্ধি ও জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থেই হালাল খাদ্য ও পণ্যের উৎপাদন ও রফতানিতে মনোযোগী হয়েছে। হালাল খাদ্য ও পণ্যের অভ্যন্তরীণ বাজার ও আন্তর্জাতিক বাজারের প্রসারণ তাদের অনুপ্রাণীত করেছে। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি দেশ এগিয়ে এসেছে। উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো মূলত আমদানি নির্ভর। তাদের বেশির ভাগ খাদ্যপণ্য ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করতে হয়। প্রধানত অমুসলিম দেশ থেকেই তাদের পণ্যের যোগান আসে। মুসলিম দেশও এই বাজারটি দখলে নিতে পারে, যদি হালাল ও মানসম্মত পণ্য রফতানি করতে পারে। হালাল খাদ্য ও পণ্যের বিশ্ববাজার দখল করতে হলে মুসলিম দেশগুলোকে সর্বাগ্রে পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রতিষ্ঠান ও উত্তম ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য চাই উদ্যমী উদ্যোক্তা, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও সরকারের নীতিসহায়তা।
হালাল খাদ্য ও পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্ভাবনা মোটেই কম নয়। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে অর্থনীতিতে একটা নবধারার সংযোজন হতে পারে। কী ধরনের পণ্য বাংলাদেশ উৎপাদন ও রফতানি করতে পারে, তার একটি তালিকা প্রণয়ন করে উৎপাদনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেকোনো পণ্য উৎপাদনের আগে প্রয়োজন হলে বিস্তর গবেষণার আশ্রয় নিতে হবে। হালাল পণ্যের সনদ একটি অপরিহার্য বিষয়। এ ব্যাপারে একটি আলাদা কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। সনদ ঠিকমত না হলে পণ্য কোথাও গ্রহণীয় হবে না। সেক্ষেত্রে সনদের ব্যাপারে স্বচ্ছতা ও বিশ্বস্থতা নিশ্চিত করতে হবে। সনদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও থাকতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের গোশত রফতানি করতে পারে। সর্বত্র এর চাহিদা রয়েছে প্রচুর। ব্রাজিল, ভারত প্রভৃতি দেশ গরু-মহিষের গোশত রফতানি করে বছরে বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। বাংলাদেশ গোশতের বিশ্ব বাজারে তার অবস্থান সহজেই মজবুত করতে পারে। অন্যান্য খাদ্য ও পণ্যসামগ্রী রফতানি করেও লাভবান হতে পারে। মুসলিম দেশগুলো হালাল খাদ্য ও পণ্যের বাজার একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে যদি এব্যাপারে একটি সংস্থা গড়ে তোলা যায়। মুসলিম বিশ্বের কমন মার্কেট গড়ে তোলার তাকিদ বহু বছর ধরে উচ্চারিত হতে হতে তা এখন প্রায় তামাদি হয়ে গেছে। যদি যথাসময়ে এই কমন মার্কেট গড়ে উঠতো, তাহলে মুসলিম বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বিকাশ এখন অন্য জায়গায় থাকতো।
যা হোক, হালাল খাদ্য ও পণ্যের বাজারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দকে চিন্তাভাবনা করতে হবে এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এটা সময়ের একান্ত দাবি। এ দাবি পূরলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসতে পারেন।