পাত্রপাত্রী বাছাইয়ে শরিয়তের নির্দেশনা

, ইসলাম

মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা, অতিথি লেখক, ইসলাম | 2023-09-01 19:21:02

মানব জীবনের অপরিহার্য অংশ দাম্পত্য জীবন। বিয়ের মাধ্যমে পরস্পর সম্পর্কিত পুরুষকে স্বামী (পতি) এবং নারীকে স্ত্রী (পত্নী) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। স্বামী-স্ত্রীর যুক্ত জীবনকে ‘দাম্পত্য জীবন’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। প্রত্যেক ধর্মেই মানব সম্প্রদায়কে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দাম্পত্য জীবন পরিচালনার তাগিদ ও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। নারী-পুরুষ একে অপরের প্রতি টান ও ভালোবাসা এক প্রাকৃতিক বিষয়, তাই আল্লাহতায়ালা প্রথম মানব-মানবীকে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করিয়ে দাম্পত্য জীবনের সূচনা করেন। বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রী বাছাইয়ে ইসলামি শরিয়তে বিশেষ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেননা দাম্পত্য জীবন মানব জীবনের সবচেয়ে মূখ্য বিষয়। একসঙ্গে দু’টি মানুষের আমৃত্যু ঘর-সংসার করার বাহ্যিক প্রতিশ্রুতিই হলো- বিয়ে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘তোমরা বিয়ে করো সেই স্ত্রীলোককে, যাদের তোমাদের ভালো লাগে।’ -সুরা আন নিসা : ৩

বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্রপাত্রী বাছাইয়ে সৌন্দর্য, সামর্থ্য, বংশগত মর্যাদা এবং বিশেষ করে দ্বীনদারিত্বের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন কোনো নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে, তখন সম্ভব হলে- তার এমন কিছু যেন দেখে নেয়, যা তাকে বিয়েতে উৎসাহিত করে।’ বর্ণনাকারী বলেন, আমি একটি মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পর তাকে দেখার আকাঙ্ক্ষা-অন্তরে গোপন রেখেছিলাম। অতঃপর আমি তার মাঝে এমন কিছু দেখি- যা আমাকে তাকে বিয়ে করতে আকৃষ্ট করল। অতঃপর আমি তাকে বিয়ে করি।’ -সুনানে আবু দাউদ : ২০৮২

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কে প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! কোন স্ত্রী সর্বোত্তম? তিনি বলেন, ‘(স্বামী) যে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে পুলকিত হয়।’ -মুসনাদে আহমদ : ১৮৩৮

বিয়েতে পাত্রপাত্রী বাছাইয়ে সৌন্দর্যের বিষয়টি আপেক্ষিক। একেকজন একেক দৃষ্টিতে সৌন্দর্য বিচার করে। একজনের কাছে যেটা মোহনীয়, অন্যজনের কাছে সেটা নাও হতে পারে। কারও কালো পছন্দ, কারও ফর্সা; আবার কারও শ্যামলা পছন্দ; কারও লম্বা প্রকৃতির পছন্দ, কারও স্বাভাবিক প্রকৃতির। কেউ বাহ্যিক চেহারা দিয়ে সৌন্দর্য বিচার করে; কেউ বিচার করে জ্ঞান, মেধা, বুদ্ধিমত্তা, যোগ্যতা ও মননশীলতা দিয়ে। বিয়ের আগে পাত্রপাত্রী একে অপরের পছন্দের ব্যাপারটি সুনিশ্চিত করতে হবে। কারণ বিয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, মনের পরিতৃপ্তি ও প্রশান্তি অর্জন। চরিত্রের সুরক্ষা ও চোখ অবনমিত রাখার ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং আপনি যদি এমন নারী বিয়ে করেন, যার দিকে তাকালে আপনার মনে আকর্ষণ সৃষ্টি হয় কিংবা ভালো লাগে, তাহলে স্বভাবতই মনে প্রশান্তি আসবে। পাশাপাশি পরনারী থেকে দৃষ্টি অবনমিত রাখতে সহায়ক হবে।

বিয়ের সময় পাত্র বাছাইয়ে পাত্রী পক্ষকে অনেক বেশি সতর্ক হতে হয়। পাত্রের বাহ্যিক রূপের চেয়ে দ্বীনদারী ও চরিত্রকে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন তোমাদের নিকট এমন কোনো পাত্র বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে, যার চরিত্র ও দ্বীনদারিতে তোমরা সন্তুষ্ট; তবে তোমরা তার বিয়ের ব্যবস্থা করে দাও। যদি তোমরা তা না করো, তবে তা পৃথিবীতে বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং ব্যাপক বিশৃঙ্খলার কারণ হবে।’ -সুনোনে তিরমিজি : ১০৮৪

আমাদের বর্তমান সমাজে পাত্র বাছাইয়ে দ্বীনদারিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হচ্ছে; পাত্রের চরিত্র ও দ্বীনদারীত্ব থেকে পাত্রের অর্থনৈতিক সামর্থ্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে সামাজিক অশান্তি ও বিয়ে বিচ্ছেদ মহামারি আকার ধারণ করেছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) দ্বীনদার মেয়েকে বিয়ের ব্যাপারে অধিক তাগিদ দিয়েছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, ‘নারীদের (সাধারণত) চারটি বিষয় দেখে বিয়ে করা হয়- ক. ধন-সম্পদ, খ. বংশমর্যাদা, গ. রূপ-সৌন্দর্য ও ঘ. দ্বীনদারি বা ধার্মিকতা। তবে তুমি দ্বীনদার (ধার্মিক) নারীকে বিয়ে করে সফল হও; অন্যথায় তুমি লাঞ্ছিত হবে।’ -সহিহ বোখারি : ৫০৯০

প্রত্যেক ধর্মেই বিয়ের বিষয়ে তাগিদ ও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে

বিয়ের ক্ষেত্রে বংশগত মর্যাদা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বংশের মানের সমতা রেখে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া উচিত। নিম্নবংশের ছেলে উচ্চবংশের মেয়ের সমান হতে পারে না, আবার নিম্নবংশের মেয়ে উচ্চবংশের ছেলের সমান হতে পারে না। বর্তমান সমাজে বংশগত মর্যাদাকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে পাত্রের ক্ষেত্রে চাকুরি এবং পাত্রীর ক্ষেত্রে বাহ্যিক রূপ-লাবণ্যকে বিয়ের পাত্রপাত্রী বাছাইয়ের মানদন্ড ধরা হয়। পাত্রপাত্রীর একজনের বংশ মর্যাদা অপরজন থেকে উচ্চমানের হলে পান থেকে চুন খসলেই বংশগত মর্যাদার দোহাই দিয়ে কথা তোলা হয়; যা যেকোনো মানুষের জন্য বিব্রতকর ও কষ্টকর ব্যাপার। বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র উচ্চবংশের এবং পাত্রী রূপ-লাবণ্যের হলেই বিয়ের জন্য অস্থির না হয়ে পাত্রের বংশগত মর্যাদার পাশাপাশি বাকি দিকগুলোও বাছাই করে নেওয়া উচিত; তদ্রুপ পাত্রীর ক্ষেত্রেও। আবার পাত্রের সামর্থ্য থাকলেও বংশগত মর্যাদা উপেক্ষা করা ঠিক না কেননা অনেকাংশে দেখা যায় বংশগত কোনো মর্যাদা না থাকার দরুণ স্ত্রীর কাছে স্বামী কোনো পাত্তাই পায় না। এজন্য পরবর্তীতে আস্তে আস্তে সংসার ভেঙ্গে যায়।

হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিয়ের আগে পাত্রপাত্রী একে অপরকে দেখতে উৎসাহিত করেছেন। অনেকে না দেখেই বিয়ে করে থাকে। এটা অনুচিত যা পরবর্তীতে সংসারে ভাঙন ধরানোর কারণ হয়। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তখন সে যেন তার এমন কিছু দেখে, যা তাকে তার সঙ্গে বিয়েতে উৎসাহিত করে।’ -সুনানে আবু দাউদ : ২০৮২

কনেকে একবার দেখে পছন্দ করা গেলে একবার দেখাই বিধান। এক্ষেত্রে বারবার দেখা অনুচিত। অনেকক্ষেত্রে একবার দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া কষ্টকর। এক্ষেত্রে একাধিকবার দেখার অনুমতি রয়েছে। আইনশাস্ত্রের ভাষ্য হচ্ছে, পাত্রের জন্য অনুমতি রয়েছে কয়েকবার দেখা, এমনকি যদি সে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তিনবারের বেশিও দেখে- যাতে তার সামগ্রিক বিষয়টি পাত্রের কাছে সুস্পষ্ট প্রতিভাত হয়। তবে যদি পাত্রপাত্রীকে একবার দেখেই পরিতৃপ্ত হয়, সেক্ষেত্রে একবারের অতিরিক্ত দেখা হারাম। কারণ এই দেখা হালাল করা হয়েছে অনিবার্য প্রয়োজনে।

নারী হলো পুরুষের সহধর্মিনী, অর্ধাঙ্গিনী, সন্তানদাত্রী, জীবন-সঙ্গিনী, গৃহের গৃহিণী, সন্তানের জননী, হৃদয়ের শান্তিদায়িনী, রহস্য রক্ষাকারিণী, তার সুখী সংসারের প্রধান সদস্যা। সুতরাং এমন সাথী নির্বাচনে পুরুষকে সত্যই ভাবতে হয়, বুঝতে হয় আবার নারীকেও পুরুষকে নিয়ে ভাবতে হয় বুঝতে হয়। শুধুমাত্র প্রেম, উচ্ছৃঙ্খলতা ও আবেগে নয়; বরং বিবেক ও বুদ্ধি দিয়ে সে বিষয়ে চিন্তা করতে হয়। সাধারণতঃ মানুষ তার হবু-সঙ্গিনীর প্রভাব-প্রতিপত্তি, মান-যশ-খ্যাতি, ধন-সম্পদ, কুলীন বংশ, মনোলোভা রূপ-সৌন্দর্য প্রভৃতি দেখে মুগ্ধ হয়ে তার জীবন-সঙ্গ লাভ করতে চায়; অথচ তার আধ্যাত্মিক ও গুণের দিকটা গৌণ মনে করে। যার ফলে দাম্পত্যের চাকা অনেক সময় অচল হয়ে রয়ে যায় অথবা সংসার হয়ে উঠে তিক্তময়। পাত্রপাত্রীর পছন্দের ক্ষেত্রে অনেক অভিভাবকের প্রবণতা হলো, পাত্রী লম্বা ও সুন্দরী হওয়া আর পাত্র ধনী বাবার সন্তান হওয়া; সঙ্গে পাত্র দেখতে স্মার্ট হলে তো আর কোনো কথাই নেই। বাকি গুণাগুণ কিছুটা কম থাকলেও তেমন যায় আসে না। অথচ এই দু’টিই ইসলামে তেমন দেখার বিষয় নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণীয় বিষয় হলো- চরিত্র ও দীনদারী।

 

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর