মুমিন অর্থ বিশ্বাসী। তাওহিদ, রেসালাত ও আখেরাতে বিশ্বাসীকে মুমিন বলা হয়। মুসলিম অর্থ অনুগত ব্যক্তি। ঈমানের সঙ্গে নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত এবং আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর যাবতীয় আদেশ-নিষেধ মেনে চলা ব্যক্তিকে মুসলিম বলা হয়।
মুমিন ও মুসলিম জন্মগত ও বংশীয় পরিচয় নয়, বিশ্বাস ও কর্মে তা অর্জন করতে হয়। কোরআন ও হাদিসে প্রকৃত মুমিনের পরিচয় ও সফল মুমিনের গুণাবলি বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।
ঈমান কাকে বলে
হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত প্রসিদ্ধ হাদিস, হাদিসে জিবরাইলে এসেছে- হজরত জিবরাইল (আ.) রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, এবার আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন, রাসুল (সা.) বললেন, ‘ঈমান হলো- তুমি ঈমান (বিশ্বাস) রাখবে আল্লাহর প্রতি, তার ফেরেশতাদের প্রতি, তার কিতাবসমূহের প্রতি, তার রাসুলদের প্রতি এবং শেষ দিবসের প্রতি। (এবং) তুমি ঈমান রাখবে তাকদিরের ভালোমন্দের প্রতি। জিবরাইল (আ.) বললেন, আপনি সত্য বলেছেন। -সহিহ মুসলিম : ৮
ভ্রাতৃত্বের দাবি
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মুমিন মুমিনের জন্য আয়না, (তার কোনো ত্রুটি দেখলে সে তা সংশোধন করে দেয়)। আর এক মুমিন অন্য মুমিনের ভাই, সে তার ভাইয়ের জমিজমাকে সুরক্ষা দেয় এবং তার ভাইকে তার পেছন থেকে আগলে রাখে। -সুনানে আবু দাউদ : ৪৯১৮
আমানতদারির বৈশিষ্ট্য
হজতর আনাস (রা.) বলেন, আল্লাহর নবী (সা.) খুতবা দিলেই বলতেন, ‘তার ঈমান নেই, যার আমানতদারি নেই; আর যার প্রতিশ্রুতিশীলতা নেই তার দ্বীনদারি নেই।’ -মুসনাদে আহমদ : ২৩৮৩
সাধারণত আমানত শব্দের যে অর্থ আমরা বুঝি, কোরআন-হাদিসে আমানতের অর্থ এরচেয়ে অনেক ব্যাপক। কোরআন-হাদিসের ভাষায় বান্দার প্রতি আল্লাহর সমস্ত হক (হুকুকুল্লাহ) আমানতের অন্তর্ভুক্ত। তেমনি মানুষের পরস্পরের মাঝে আস্থা ও নির্ভরতার যত ক্ষেত্র আছে সবই আমানতের অন্তর্ভুক্ত। মুসলিম সমাজের সর্বস্তরে, মুসলিম জীবনের সর্বক্ষেত্রে যেন আমানত রক্ষার পরিবেশ গড়ে উঠে সে বিষয়ে কোরআন-হাদিসে বহু হেদায়েত ও তাকিদ এসেছে।
ঈমানের দাবি
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে আল্লাহ এবং শেষ দিবসের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার মেহমানকে ইকরাম (সম্মান) করে। যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে, আর না হয় নীরব থাকে। -সহিহ বোখারি : ৬০১৮
প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেওয়া, তাদের সঙ্গে সদাচার এবং অতিথির আতিথ্য- এসব বিষয়কে মনে করা হয় শুধুই ভদ্রতা ও সামাজিকতার বিষয়। অথচ আল্লাহর নবী (সা.) হাদিসে বিষয়গুলো কীভাবে উপস্থাপন করেছেন- যে আল্লাহর ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন...। অর্থাৎ এটিও একটি দ্বীনী কাজ এবং ঈমানের একটি শাখা।
ইসলামে মেহমান ও মেজবানের বিষয়ে বিস্তারিত বিধান রয়েছে, বিভিন্ন আদব রয়েছে। সেসব বিধান ও আদব রক্ষা করে যদি আমলটি করা হয়, তাহলে একদিকে তা যেমন অতি ফজিলতপূর্ণ কাজ, তেমনি তা মেহমান-মেজবান উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রশান্তি ও আনন্দের বিষয়।
হাদিসের পরবর্তী প্রসঙ্গ হলো- হয় ভালো কথা বলবে, না হয় নীরব থাকবে। মানুষের পারস্পরিক জীবনে স্বভাব ও চরিত্রগত যে দিকগুলো সবচেয়ে বেশি সামনে আসে এবং যার প্রভাব বিস্তৃত হয়ে থাকে- সেগুলোর একটি হলো- পরস্পর কথা বলা। হাদিসের নির্দেশনা হলো, কথা বললে হয় ভালো কথা বলব, আর না হয় নীরব থাকব। এটা একটি ঈমানি আমল। সর্বস্তরের ও সর্বশ্রেণির মুমিনের জন্য এই আমলের বিষয়ে যত্নবান থাকা কর্তব্য। এর সুফল দুনিয়া ও আখেরাতে সে লাভ করবে। পক্ষান্তরে এই বিষয়ে সচেতন না হলে, পার্থিব জীবনে যেমন অশান্তি দেখা দেবে- তেমনি এর জন্য আখেরাতেও জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে।
প্রতিবেশীর সঙ্গে মুমিন
হজরত আবু শুরাইহ খুজায়ি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়, আল্লাহর কসম সে মুমিন নয়, আল্লাহর কসম, সে মুমিন নয়। জানতে চাওয়া হলো- কে ইয়া রাসুলুল্লাহ! তিনি বললেন, যার অনিষ্ট ও উৎপীড়ন থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না।’ -সহিহ বোখারি : ৬০১৬
বর্ণিত হাদিসের উপস্থাপনা থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহর রাসুল (সা.) কী প্রতাপ নিয়ে বিষয়টি ইরশাদ করেছেন। কত কঠিন ছিল বলার ভাব! মুসলিম শরিফের এক হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, সে জান্নাতে যাবে না, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না।’ -সহিহ মুসলিম : ৪৬
রাসুল (সা.)-এর এমন হুঁশিয়ারির পরও প্রতিবেশীর সঙ্গে আচরণ সুন্দর না করা, সত্যিই বড় দুর্ভাগ্যের কথা। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘সে তো মুমিন নয়, যে নিজে তৃপ্তিভরে আহার করে, আর তার প্রতিবেশী থাকে অনাহারে, অর্ধাহারে।’ -আদাবুল মুফরাদ : ১১২
পূর্ণাঙ্গ মুমিন
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহু (সা.) বলেছেন, ‘ঈমানের দিক থেকে মুমিনদের মধ্যে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ ওই ব্যক্তি, যে সবচেয়ে সুন্দর চরিত্রের অধিকারী।’ -সুনানে আবু দাউদ : ৪৬৮২
অর্থাৎ ঈমানের পূর্ণতা চরিত্রের সৌন্দর্যের উপর নির্ভরশীল। যে যত সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হবে, তার ঈমান তত বেশি পূর্ণাঙ্গ হবে।
মুমিনের চরিত্রের মহাত্ম্য সম্পর্কে আরও বলা যায়, আল্লাহর যে বান্দা নিজের আমল-আকিদা, কর্ম ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সত্যিকারের মুমিন হবে, সেই সঙ্গে সুন্দর চরিত্রের অধিকারীও হবে, সে যদিও রাতে বেশি নফল নামাজ পড়ে না, বেশি রোজা রাখে না, তবুও সে তার সুন্দর চরিত্রের কারণে ওই ব্যক্তির মর্যাদা লাভ করবে, যে দিনে রোজা রাখে, আর রাতভর নফল নামাজ আদায় করে।