পারিবারিক অশান্তি ও সামাজিক অবক্ষয় বাড়ার কারণ

বিশেষ নিবন্ধ, ইসলাম

সাইদুর রহমান শাহিদ, অতিথি লেখক, ইসলাম | 2023-11-17 21:39:26

বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপন এবং তার পরিণতিতে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ সমাজে মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। ফলে ঘন ঘন নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার হচ্ছে দেশের নানা জায়গা থেকে। দিন দিন বাড়ছে এই জঘন্যতম অপরাধের হার। এর কারণ কী কী হতে পারে, সে বিষয়ে সবারই কমবেশি ধারণা রয়েছে।

বর্তমান সময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির। ইন্টারনেট সংযোগ গোটা বিশ্বকে এনে দিয়েছে হাতের মুঠোয়। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা। ফলে ইন্টারনেটে যুক্ত স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও অন্যান্য ডিভাইস বহির্বিশ্বের বিশ্বাস, প্রথা, সংস্কৃতি ও জীবনাচরণের মতো ব্যাপারগুলো খুব ব্যাপকতার সঙ্গে আমাদের সামনে উপস্থাপন করছে। মানুষ তাতে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।

বিশ্বের বহুদেশে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের রেওয়াজ রয়েছে, যা লিভ টুগেদার নামে পরিচিত। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের সমাজের একশ্রেণির মানুষের চিন্তাধারায়। খেয়াল করলে দেখবেন, বর্তমানের সিনেমা-নাটকে লিভ টুগেদারকে অনেকটা স্বাভাবিক বিষয় ও ইতিবাচক ভঙ্গিতে তুলে ধরা হয়। সেখান থেকে অনেকেই এ বিষয়ে আগ্রহী হয়। তরুণ-তরুণীদের মাঝে অবাধ মেলামেশার প্রবণতা থেকে অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে এমন কাজে।

যৌন আকাঙ্খা যেহেতু মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য, সেহেতু বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকাঙ্খা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক বিষয়; ফলে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের পরিণতিতে ঘটছে অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ। পরবর্তীতে লোকলজ্জা বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ে কিংবা সমাজে ওই সন্তান স্বীকৃতি না পাওয়ার ভয়ে করছে গর্ভপাত। শহরের বিভিন্ন আবর্জনার স্তূপ, ডাস্টবিন আর ড্রেনে ঘন ঘনই উদ্ধার হচ্ছে নবজাতকের লাশ। যা বর্বরতম ঘৃণ্য একটি অপরাধ।

বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নিষিদ্ধ এবং পাপের কাজ। মানুষ ধর্মীয় অনুশাসন না মেনে চলার কারণেই জড়িয়ে পড়ছে এহেন গর্হিত কাজে। ইসলাম ধর্মে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক বা ব্যভিচারকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ বিষয়ে স্বয়ং আল্লাহ এবং হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এবং এর শাস্তি সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘আর তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তীও হয়ো না। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট পন্থা।’-সুরা বনী ইসরাঈল : ৩২

এ বিষয়ে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি যখন ব্যভিচার করে, তখন তার ভেতর থেকে ঈমান বেড়িয়ে যায়, এরপর তা তার মাথার ওপর ছায়ার মতো অবস্থান করতে থাকে। এরপর সে যখন তা থেকে তওবা করে, তখন তার ঈমান পুনরায় তার কাছে ফিরে আসে।’ -সুনানে আবু দাউদ

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা তিন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না, তাদেরকে পবিত্রও করবেন না এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক কঠোর শাস্তি নির্ধারিত থাকবে। তারা হচ্ছে বৃদ্ধ ব্যভিচারী, মিথ্যাবাদী শাসক এবং অহংকারী গরীব।’-সহিহ মুসলিম

অন্য আরেক হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ব্যভিচারের শাস্তির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘আমি স্বপ্নে একটি চুলা দেখতে পেলাম, যার ওপরের অংশ ছিল চাপা আর নিচের অংশ ছিল প্রশস্ত আর সেখানে আগুন উত্তপ্ত হচ্ছিল, ভেতরে নারী-পুরুষরা চিৎকার করছিল। আগুনের শিখা ওপরে আসলে তারা ওপরে উঠছে, আবার আগুন স্তিমিত হলে তারা নিচে যাচ্ছে, সর্বদা তাদের এ অবস্থা চলছিল, আমি হজরত জিবরাইল (আ.) কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? হজরত জিবরাইল (আ.) বলেন, তারা হলো- অবৈধ যৌনচারকারী নারী ও পুরুষ। -সহিহ বোখারি

বর্তমান সমাজে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশাকে খুব সাধারণ বিষয় হিসেবে দেখা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে, যাত্রাপথে সহযাত্রী হিসেবে, ফেইসবুক বা অনলাইনে পরিচিতির খাতিরে নারী-পুরুষের মাঝে বেশ সখ্যতা গড়ে ওঠে। ইসলামি দৃষ্টিকোণে এগুলো নিষিদ্ধের আওতায়। এ ব্যাপারে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো বেগানা নারীর প্রতি দৃষ্টি দেওয়া চোখের জিনা, অশ্লীল কথাবার্তা বলা জিহ্বার জিনা, অবৈধভাবে কাউকে স্পর্শ করা হাতের জিনা, ব্যাভিচারের উদ্দেশ্যে হেঁটে যাওয়া পায়ের জিনা, খারাপ কথা শোনা কানের জিনা আর জিনার কল্পনা করা ও আকাঙ্খা করা মনের জিনা। অতঃপর লজ্জাস্থান একে পূর্ণতা দেয় অথবা অসম্পূর্ণ রেখে দেয়।’ -সহিহ বোখারি

ব্যভিচারের ফলে জন্মলাভ করা সন্তানকে শান্তির ধর্ম ইসলাম মেরে ফেলতে বলেনি। বরং তার সুরক্ষা ও ভরণপোষণের ব্যাপারে তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে সেই শিশু নিষ্পাপ, তাকে সেই পাপের অংশীদার না বানানোর কথা বলা হয়েছে। ইসলামি শরিয়তে ব্যভিচারের ফলে জন্মলাভ করা সন্তান মায়ের পরিচয়ে পরিচিত হবে, যেহেতু তার পিতা অবৈধ এবং মাকেই তার ভরণপোষণের দায়ভার গ্রহণ করতে হবে।

কিন্তু আমাদের সমাজে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপনে তো একটি পাপ করছে উপরন্তু নবজাতককে হত্যা করে আরও একটি মহাপাপ করছে। এমন জঘন্যতম অপরাধ বন্ধে আমাদেরকে তৎপর হতে হবে। জীবনে ধর্মীয় রীতিনীতি, বিধিনিষেধ এবং অনুশাসন মেনে চলার পাশাপাশি বেশ কিছু বাড়তি সতর্কতা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এরকম ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড বিনাশ করা সম্ভব হবে। সেগুলো হলো-

সন্তানদের মাঝে ধর্মীয় জ্ঞানের প্রসার ঘটানো এবং নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। এমন অবৈধ সম্পর্কের পরিণতি সম্পর্কে ব্যাপকভাবে জানানোর ব্যবস্থার পাশাপাশি পরকালের শাস্তির আলোচনা বেশি বেশি করা। তরুণ-তরুণীদের মধ্যকার অবাধ মেলামেশা নিয়ন্ত্রণে অভিভাবক ও শিক্ষকদের সচেতন হওয়া। ইন্টারনেটের নেতিবাচক প্রভাবের ব্যাপারে জনগণকে অবহিত করা। নবজাতক হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান কার্যকর করা।

প্রাপ্তবয়স্কদের অনতিবিলম্বে বিয়ের ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের ঘাটতির মতো সমস্যা নিরসনে উদ্যোগী হওয়া। সর্বোপরি জীবনের সর্বক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা। কোনো ব্যক্তি যদি পরিপূর্ণভাবে ধর্মকে লালন করে, তাহলে তার দ্বারা এমন গর্হিত পাপকার্য সম্পন্ন হওয়ার কথা নয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর