কোরআন-হাদিসের শিক্ষা অনুযায়ী হুকমত (শাসনভার বা রাজত্ব) একটি দায়িত্ব। এটি এমন কোনো অধিকার নয়, যা হাসিলের জন্য মানুষ চেষ্টা চালাবে। এ জন্য হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ইমাম (রাষ্ট্রপ্রধান) দায়িত্বশীল। যেই দায়িত্ব তার কাঁধে অর্পণ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে তাকে জবাবদিহি করতে হবে।’ -সহিহ বোখারি : ৮৯৩
এই ধারণার অত্যাবশ্যক ফলাফল হচ্ছে, একে এমন একটি দায়িত্ব ও কর্তব্য জ্ঞান করতে হবে, যা থেকে দূরে থাকা উত্তম। তবে যদি প্রয়োজনে কোনো ব্যক্তির ওপর তা চেপে বসে, তাহলে একে একটি আমানত ও জিম্মাদারি মনে করে আঞ্জাম দেবে।
খেলাফতের পরিচয়
‘খেলাফত’ আরবি শব্দ। যা শাসন, কর্তৃত্ব প্রভৃতি অর্থে ব্যবহৃত হয়। ‘আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও আইনগত কর্তৃত্বকে মেনে নিয়ে পবিত্র কোরআন-সুন্নাহর মৌলিক নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্র ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাকে ইসলামি পরিভাষায় খেলাফত বলা হয়। ব্যাখ্যাদাতারা এ বিষয়ে অনেক বিশ্লেষণ করেছেন। এক কথায় খেলাফত হচ্ছে, আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-এর আদর্শ বাস্তবায়নের প্রতিনিধিত্ব।
খলিফা পরিচিতি
‘খলিফা’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ প্রতিনিধি। ইসলামি পরিভাষায় খলিফা হলেন- এমন ব্যক্তি, যিনি শরিয়ত অনুযায়ী তার অধীনদের পরিচালনা করেন। ইসলামি রাষ্ট্রে খলিফা সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে গভর্নর, শাসক ও কাজি (বিচারক) নিযুক্ত করেন।
খলিফার যোগ্যতা ও বৈশিষ্ট্য
ইসলামের একটি স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য হলো, খলিফা বা প্রতিনিধির গুণের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তির মাঝে এই বৈশিষ্ট্যগুলো পূর্ণরূপে না পাওয়া যাবে, ততক্ষণ সে খলিফা হতে পারবে না। আলেমরা এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। নিচে খলিফা তথা রাষ্ট্রপ্রধানের বৈশিষ্ট্যাবলি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-
এক. মুসলিম হওয়া। দুই. বুঝমান, প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ বিবেকের অধিকারী হওয়া। তিন. পুরুষ হওয়া। চার. স্বাধীন হওয়া। পাঁচ. ন্যায়পরায়ণ হওয়া। ছয়. জ্ঞান (ইলম তথা ইজতিহাদ করার যোগ্যতা) থাকা। সাত. কোরাইশ বংশীয় হওয়া। অবশ্য অ-কোরাইশের কেউ ইমাম বা খলিফা নির্বাচিত হয়ে গেলে তার খেলাফতও কার্যকর সাব্যস্ত হবে।
খলিফা নির্বাচন পদ্ধতি
নবী কারিম (সা.) খলিফা হিসেবে কারো নাম ঘোষণা করেননি। তিনি নির্বাচনের বিষয়টি সাহাবায়ে কেরামের ওপর ছেড়ে গেছেন। এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, খলিফা নির্বাচন করার বিষয়টি মুসলমানদের রায়ের ওপর ন্যস্ত। পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরাম খলিফা নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করেছেন তা চার প্রকারে বিভক্ত।
মৌন নির্বাচিত ব্যক্তির খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ
ইসলামি পরিভাষায় একে ‘বাইআতু আহলিল হল ওয়াল আকদ’ বলা হয়। কেননা যারা নায়েব বা প্রতিনিধি তাদের হাতেই দীনি ব্যবস্থাপনা ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত। এক্ষেত্রে যার ভূমিকা বেশি তিনিই হবেন প্রথম খলিফা। হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এই পদ্ধতিতে খলিফা নির্বাচিত হয়েছেন।
খলিফা কর্তৃক খলিফা নির্বাচন
খলিফা নিজেই তার পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত করে যাওয়া। ন্যায়পরায়ণ, জনকল্যাণকামী, নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিকে তার পরবর্তী খলিফা ঘোষণা করা এবং তার আনুগত্য করার নির্দেশ দেওয়া। এই পদ্ধতিতে খলিফা নির্বাচিত হয়েছেন হজরত ওমর ফারুক (রা.)।
শূরা সদস্যদের পরামর্শে নির্বাচন
হজরত ওমর (রা.) তার পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্য ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটিকেই খলিফা নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়। তারা হজরত উসমান (রা.) কে নির্বাচন করেন। হজরত উসমান (রা.) শাহাদাতবরণ করার পর তারা হজরত আলী (রা.) এর কাছে উপস্থিত হয়ে তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেন।
বলপ্রয়োগ বা প্রাধান্য বিস্তারের নিমিত্তে দায়িত্ব গ্রহণ
খলিফার মৃত্যুর পর জনগণের আনুগত্য ছাড়া এবং খলিফার উত্তরাধিকার তথা মনোনয়ন ব্যতীত তা গ্রহণ করা। যদি শরিয়ত মোতাবেক খেলাফত চালিয়ে নেয়, তহলে তার আনুগত্য করাও ওয়াজিব।