দয়াময় আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি এক বিরাট দান- ইসতিখারা। মানুষ দুনিয়ার জীবনে অনেক কিছুর মুখাপেক্ষী। এ সব বিষয়ে সে আসমানি সান্তনার ছায়া পেতে পারে ইসতিখারার মাধ্যমে।
আল্লাহর ফয়সালার প্রতীক্ষা, তার হুকুমের সামনে নিজেকে সমর্পণ এবং আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট হওয়ার অপূর্ব অনুশীলন এই ইসতিখারা। এরচেয়েও বড় কথা, ইসতিখারার মাধ্যমে বান্দা যেন সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে সিদ্ধান্ত পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে। নিজের ভবিষ্যত ও ভবিষ্যতের পরিণাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, দ্বিধাগ্রস্ত, দোদুল্যমান বান্দার জন্য এটা অনেক বড় প্রাপ্তি!
হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ইসতিখারার আমল শিক্ষা দিয়েছেন। হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে কোরআনের সুরা যেভাবে শেখাতেন, সব বিষয়ে (সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে) সেভাবে ইসতিখারা করতে শিখিয়েছেন। -সহিহ বোখারি : ১১৬৬
ইসতিখারা শব্দের অর্থ খাইর বা কল্যাণ প্রার্থনা করা। অর্থাৎ যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার আগে এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালার কাছে কল্যাণ প্রার্থনা এবং দোয়া করা যে, হে আল্লাহ! যেভাবে এই কাজ করলে আমার জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ হবে, সেভাবে কাজটি করার তওফিক দান করুন। তার জন্য সহায়ক সব উপকরণের ব্যবস্থা আপনি করে দিন এবং আমার মনকে সেদিকে ঝুঁকিয়ে দিন। আর যেভাবে করলে অকল্যাণ হবে, সেভাবে করা থেকে বিরত রাখুন এবং আমার মনকে আপনার ফয়সালার ওপর সন্তুষ্ট করে দিন। মনের দ্বিধা ও দোদুল্যমানতা দূর করে দিন।
দুই রাকাত নামাজ পড়ে নবী কারিম (সা.)-এর শেখানো বিশেষ একটি দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কল্যাণ চাওয়াকে ইসতিখারা বলে। ইসতিখারা করা সুন্নত। দ্বীন-দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ যেকোনো কাজ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে কর্তব্য হলো-
প্রথমে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধিকে ব্যবহার করা। সেই কাজ ও সিদ্ধান্তের নানা দিক বিবেচনা করে ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ এবং উপকারী-অনোপকারী বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা। এরপর দুই রাকাত নামাজ পড়ে নবী কারিম (সা.)-এর শেখানো দোয়া মাধ্যমে ইসতিখারা করা। আল্লাহর কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করা। সেই সঙ্গে আপনজন, ঘনিষ্ঠজন, হিতাকাঙ্ক্ষী ও অভিজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করা। শরিয়তে পরামর্শের গুরুত্ব অনেক। ইরশাদ হয়েছে, ‘(গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে) আপনি সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করুন।’ -সুরা আলে ইমরান : ১৫৯
ইসতিখারার পদ্ধতি ও দোয়া
সহিহ বোখারিসহ হাদিসের নির্ভরযোগ্য কিতাবে হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, হজরত রাসুলে কারিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখনই কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার ইচ্ছা করবে প্রথমে দুই রাকাত নামাজ পড়বে। এরপর বলবে- (উচ্চারণ) : আল্লাহুম্মা ইন্নি আসতাখিরুকা বি ইলমিকা ওয়াস্তাকদিরুকা বি কুদরাতিকা; ওয়া আসআলুকা মিন ফাদ্বলিকাল আজিম। ফাইন্নাকা তাকদিরু ওয়ালা আকদিরু, ওয়া তালামু ওয়ালা আলামু; ওয়া আন্তা আল্লামুল গুয়ুব। আল্লাহুম্মা ইন কুনতা তালামু আন্না হাজাল আমরা (এখানে নিজের কাজের কথা মনে মনে উল্লেখ করবেন) খাইরুন-লি ফি দ্বীনি, ওয়া মাআশি ওয়া আ-ক্বিবাতি আমরি (অথবা বলবে, আজিলি আমরি ওয়া আজিলিহি); ফাকদিরহু লি ওয়া ইয়াসসিরহু লি, সুম্মা বারিকলি ফিহি; ওয়া ইন কুনতা তালামু আন্না হাযাল আমরা (এখানে নিজের কাজের কথা মনে মনে উল্লেখ করবেন) শাররুন লি ফি দ্বীনি ওয়া মাআশি ওয়া আ-ক্বিবাতি আমরি (অথবা বলবে, আজিলি আমরি ওয়া আজিলিহি); ফাসরিফহু আন্নি- ওয়াসরিফনি আনহু, ওয়াকদির লিয়াল খাইরা হাইসু কানা সুম্মারদ্বিনি বিহি।’
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আপনার ইলমের উসিলায় আপনার কাছে (আমার উদ্দিষ্ট বিষয়ের) কল্যাণ চাই এবং আপনার কুদরতের ওসিলায় আপনার কাছে (কল্যাণ অর্জনের) শক্তি চাই, আর আপনার কাছে চাই আপনার মহাঅনুগ্রহের কিছু। কেননা, (সব বিষয়ে) আপনার ক্ষমতা রয়েছে, আমার কোনো ক্ষমতা নেই। আপনি (সবকিছু) জানেন, আমি কিছুই জানি না। আপনি তো গায়েবের (অদৃশ্যের) সব বিষয়ে সম্যক অবগত। (আমার কাঙ্ক্ষিত বিষয়টি আমার জন্য কল্যাণকর কি না- তা আপনিই জানেন, আমি জানি না।) হে আল্লাহ! আমার দ্বীন, আমার জীবন-জীবিকা ও কাজের পরিণামের বিচারে যদি এ বিষয়টি আমার জন্য কল্যাণকর বলে জানেন, তাহলে আমার ভাগ্যে তা নির্ধারণ করে দিন এবং বিষয়টিকে আমার জন্য সহজ করে দিন। এরপর তাতে আমার জন্য বরকত দান করুন।
আর যদি বিষয়টি আমার দ্বীন, আমার জীবন-জীবিকা ও কাজের পরিণাম বিচারে আমার জন্য ক্ষতিকর বলে জানেন, তাহলে আপনি তা আমার থেকে সরিয়ে দিন এবং আমাকে তা থেকে ফিরিয়ে রাখুন। আর আমার জন্য কল্যাণের ফায়সালা করুন; তা যেখানেই হোক। অতপর তাতেই যেন আমি সন্তুষ্ট হয়ে যাই সেই তওফিক দান করুন। -সহিহ বোখারি : ১১৬৬
অনেকের ধারণা-ইসতিখারা করার সময় হলো- রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে। ধারণাটি ঠিক নয়। ইসতিখারা করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই বরং যখন প্রয়োজন হবে তখনই ইসতিখারা করবে। তাতে রাত-দিন বা ঘুমানো-জাগ্রত থাকার কোনো বিষয় নেই।
কারও কারও ধারণা, ইসতিখারার পর বিশেষ একটি স্বপ্ন দেখা যায়। সেখানে কাজটির ভালো-মন্দ সম্পর্কে নির্দেশনা থাকে। কিংবা কাজটি করা না করার বিষয়ে কোনো আদেশ-নিষেধ থাকে। এমন ধারণাও ভিত্তিহীন। ইসতিখারার সঙ্গে এমন কোনো স্বপ্ন বা ইঙ্গিত-ইশারার আবশ্যকীয়তা নেই। তবে কখনও এমন কোনো স্বপ্ন কেউ দেখতে পারে, কিংবা কেউ কোনো ইশারা-ইঙ্গিত পেতে পারে, সেটা ইসতিখারার অনিবার্য বিষয় নয়। তাই এমন স্বপ্ন-ইশারার অপেক্ষা করবে না।
কোনো কোনো বুজুর্গ বলেন, ইসতিখারা করলে সম্ভাব্য বিষয়গুলোর কোনো একটির দিকে দিলের ঝোঁক সৃষ্টি হয়। তবে যদি কোনো দিকে ঝোঁক নাও হয় এবং কোন্ কাজটি করবে সে ব্যাপারে মনে দ্বিধাদ্বন্দ্বও থেকে যায় তবু ইসতিখারার মাকসাদ পূর্ণ হয়ে যাবে। কারণ, ইসতিখারা করার পর আল্লাহতায়ালা তার বান্দাকে দিয়ে সেই কাজই করিয়ে নেন, যা বান্দার জন্য কল্যাণকর। ইসতিখারার পর সেই কাজেরই প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি তৈরি হয়, যাতে বান্দার জন্য কল্যাণ নিহিত থাকে। বান্দা তখন নিজের অজান্তেই সেই কাজের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে।
আবার কখনও বান্দা কোনো বিষয়কে কল্যাণকর মনে করে সেটি করতে চেষ্টা করে। কিন্তু হঠাৎ কোনোভাবে সেই কাজে বাধা সৃষ্টি হয়। ফলে সেই কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। এভাবে আল্লাহতায়ালা বান্দাকে তা থেকে বিরত রাখেন। অতএব ইসতিখারা করার পর বান্দা ধীরে ধীরে কাজের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে। আল্লাহ তাকে কল্যাণকর বিষয়ের দিকেই নিয়ে যাবেন- এই বিশ্বাস রেখে কাজ করবে।