ভারতে এবারের লোকসভা নির্বাচনে মুসলিম সংসদ সদস্যের সংখ্যা আরও কমেছে। বিভিন্ন দলের ৭৮ জন প্রার্থীসহ স্বতন্ত্র ৪৩ জন মুসলিম প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয় পেয়েছেন মাত্র ২৪ জন।
এর আগে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মুসলিম প্রার্থী ছিলেন ১১৫ জন। সেবার জয় পান ২৭ জন। ২০১৪ সালের লোকসভায় মুসলিম সংসদ সদস্যের সংখ্যা ছিলো ২৩ জন।
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮০ সালে লোকসভায় সর্বোচ্চ ৪৯ জন সংসদ সদস্য ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের।
এবারের লোকসভায় বিজয়ী ২৪ প্রার্থীর মধ্যে কংগ্রেসের ৭ জন, তৃণমূল কংগ্রেসের ৫ জন, সমাজবাদী পার্টির ৪ জন, ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগের (আইইউএমএল) ৩ জন, ন্যাশনাল কনফারেন্সের (এনসি) ২ জন, স্বতন্ত্র ২ জন এবং অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন (এআইএমআইএম)-এর একজন প্রার্থী রয়েছেন।
লোকসভায় বিজেপির কোনো মুসলিম এমপি নেই। ২০১৯ সালেও কোনো মুসলিম এমপি ছিল না। ওই নির্বাচনে সারা দেশে বিজেপি ছয়জন মুসলিম প্রার্থীকে টিকিট দিয়েছিল। এবার দিয়েছিল মাত্র একজনকে। কেরালার মাল্লাপুরমের প্রার্থী আবদুল সালাম অবশ্য জয়লাভ করতে পারেননি।
এবারের নির্বাচনে জয়ী মুসলিম এমপিরদের মধ্যে অন্যতম হলেন- ভারতের সাবেক ক্রিকেট তারকা ইউসুফ পাঠান, আসামের ধুবরি লোকসভার সদস্য রাকিবুল হুসেন, এসপির আফজাল আনসারী ও অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন (এআইএমআইএম) দলের নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি অন্যতম।
মুসলিম সংসদ সদস্যদের মধ্যে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের ধুবরি লোকসভা আসন থেকে ৯ লাখ ২০ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী রাকিবুল হুসেন। তিনি এআইইউডিএফ প্রার্থী মাওলানা বদরুদ্দিন আজমলকে পরাজিত করেছেন।
কংগ্রেসের অন্য এমপিরা হলেন- বিহারের কিষাণগঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রের ড. মুহাম্মদ জাভেদ। ২০১৯ সালের নির্বাচনেও তিনি জয়ী হন। বিহার থেকে আরেক কংগ্রেস প্রার্থী তারিক আনোয়ার কাটিহার কেন্দ্র থেকে জয় পেয়েছেন ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৯২ ভোটে।
উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর আসনে কংগ্রেসের ইমরান মাসুদ জয়ী হয়েছেন। তিনি নিকটতম বিজেপি প্রার্থী রাঘব লখনপাল থেকে ৬৪৫৪২ ভোট বেশি পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে মালদা দক্ষিণ থেকে কংগ্রেস প্রাথী ঈশা খান চৌধুরী ৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৯৫ ভোটে জয়ী হন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে জয় পাওয়া একমাত্র কংগ্রেস প্রার্থী তিনি।
লাক্ষাদ্বীপ থেকে কংগ্রেস নেতা হামদুল্লা সাঈদ এনসিপি প্রার্থী মুহাম্মদ ফয়জুলকে হারিয়ে ২ হাজার ৬৪৭ ভোটে জয়ী হয়েছেন। এছাড়া কেরালার ভদকরা আসন থেকে সাফি পারামবিল জয় পেয়েছেন ৫ লাখের বেশি ভোটে।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস থেকে জয়ী হয়েছেন ৫ জন মুসলিম প্রার্থী। তাদের অন্যতম হলেন- ভারতের সাবেক ক্রিকেট তারকা ইউসুফ পাঠান। তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বহরমপুর আসন থেকে কংগ্রেস প্রার্থী ছয়বারের এমপি অধীর রঞ্জন চৌধুরিকে হারিয়েছেন। তৃণমূল কংগ্রেস অন্য মুসলিম এমপিরা হলেন- খলিলুর রহমান (জঙ্গিপুর), আবু তাহের খান (মুর্শিদাবাদ), শেখ নুরুল ইসলাম (বসিরহাট) ও সাজদা আহমেদ (উলুবেড়িয়া)।
উত্তর প্রদেশ থেকে সমাজবাদী পার্টির ৪ জন মুসলিম প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। তার মধ্যে উত্তর প্রদেশের কাইরানা আসন থেকে ২৯ বছর বয়সী নারী প্রার্থী ইকরা চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ভারতীয় জনতা দলের (বিজেপি) প্রার্থী প্রদীপ কুমারকে ৬ লাখ ৯১ হাজার ১৬ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন।
উত্তর প্রদেশের গাজীপুর আসন থেকে জয়ী সমাজবাদী পার্টির আরেক প্রার্থী আফজাল আনসারি। প্রায় ৫ লাখ ৪০ হাজার ভোট পাওয়া আনসারি এর আগেও এই আসন থেকে লোকসভার সদস্য ছিলেন।
এর পাশাপাশি উত্তর প্রদেশের রামপুর আসন থেকে জয়ী হয়েছেন সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী মহিবুল্লাহ। উত্তর প্রদেশের সম্বল থেকে জয়ী পেয়েছেন সমাজবাদী পার্টির আরেক প্রার্থী জিয়াউর রহমান।
১৯৫২ সাল থেকে প্রতিটি লোকসভা নির্বাচনে অংশ নিয়ে ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ (আইইউএমএল) তাদের প্রতিনিধি সংসদে পাঠিয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় এবার তাদের ৩ জন প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। তারা হলেন- কেরালার মলপ্পুরম আসনের ইটি মোহাম্মদ বশীর। তিনি ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৬ ভোটে জয় পেয়েছেন। কেরালার পোন্নানি আসন থেকে অপরপ্রার্থী আবদুস সামাদ সামদানী পাঁচ লাখের বেশি ভোটে জয়ী হয়েছেন। একইদলের আরেক প্রার্থী কে নাভাসকানি জয়ী হয়েছেন তামিলনাড়ুর রামানাথপুরম আসন থেকে। তিনি হারিয়েছেন তামিলনাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী পনিরসেলভামকে।
আইইউএমএল সমর্থিত কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউডিএফও কেরালায় ২০টির মধ্যে ১৮টি আসন পেয়েছে, অন্যদিকে ডিএমকে-আইইউএমএল-কংগ্রেস জোট তামিলনাড়ুর ৩৯টি আসন লাভ করেছে।
জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ-রাজৌরি আসনে থেকে জয়ী হয়েছেন ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রার্থী মিয়া আলতাফ আহমেদ। তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতিকে পরাজিত করেছেন। শ্রীনগরের আসন থেকে পাস করেছেন একই দলের প্রার্থী আগা সৈয়দ রুহুল্লাহ মেহেদি।
অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন (এআইএমআইএম) দলের নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি তিন লাখ ৩৮ হাজারেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়ে তার হায়দ্রাবাদের আসন ধরে রেখেছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বিজেপির মাধবী লতা কমপেল্লা।
কেন্দ্রশাসিত লাদাখে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ হানিফা জান। তিনি ইন্ডিয়া জোটের সেরিং নামগিয়ালকে পরাজিত করেছেন।
কেন্দ্রশাসিত জম্মু ও কাশ্মীরের বারামুল্লাহ আসনে জয়ী হয়েছেন আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল রশীদ শেখ। কারাগার থেকে বন্দি অবস্থায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি হারিয়েছেন কাশ্মীরের হেভিওয়েট প্রার্থী ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহকে।
ভারতের লোকসভা, রাজ্যসভা, বিধানসভা ও বিধান পরিষদের মুসলিম প্রতিনিধির হার দিন দিন কমছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে বেশিরভাগ বিরোধী দল ধর্মীয় মেরুকরণের ভয়ে মুসলিম প্রার্থীদের টিকিট দেওয়া কমিয়ে দিয়েছে।
২০২৪ সালের নির্বাচনের কংগ্রেস মাত্র ১৯ জন মুসলিম প্রার্থী মনোনয়ন দেয়, ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৪। ২০১৯ সালে ১৩টির তুলনায় এবার তৃণমূল কংগ্রেস মাত্র ছয়জন মুসলিমকে প্রার্থী করে। এবার সমাজবাদী পার্টির মাত্র চারজন মুসলিম প্রার্থী ছিল, যা ২০১৯ সালের অর্ধেক।
২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, এসপি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি), জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি) এবং কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-মার্কসবাদী (সিপিআই-এম), জনতা দল ইউনাইটেড (জেডিইউ), ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি), অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন (এআইএমআইএম), ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ (আইইউএমএল) ও মায়াবতীয় দল বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) ৭৮ জন মুসলিমকে দলীয় প্রার্থী করে।
তার মধ্যে বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) সর্বাধিক ৩৫ জন মুসলিমকে প্রার্থী করেছিল। যদিও বিরোধী দলগুলো মায়াবতীর এমন সিদ্ধান্তকে মুসলিম ভোট ভাগাভাগির কৌশল বলে আখ্যায়িত করেছেন।
প্রায় দেড় মাস ধরে সাত দফায় ভোট গ্রহণ শেষে মঙ্গলবার (৪ জুন) লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। চূড়ান্ত ফলাফলে বিজেপি ২৪০ ও কংগ্রেস ৯৯টি আসনে জয়ী হয়। এককভাবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ২৭২ আসন পেতে বিজেপির আরও ৩২টি আসনের প্রয়োজন ছিল। তবে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ২৯৩ আসন পেয়েছে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট পেয়েছে ২৩৩ আসন।
মুফতি এনায়েতুল্লাহ: অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম