পরিভাষায় আশুরা বলতে মহররম মাসের ১০ তারিখকে বোঝায়। মহররম হলো ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। বছরের প্রথম মাস হিসেবে মহররম যতটা না গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে বহুগুণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আশুরা।
চেতনার মিলনায়তনে আশুরা মানে মহররম আর মহররম মানেই আশুরা। মহাকালের যাত্রালগ্ন থেকে আশুরা বহু উত্থান-পতন, ভাঙা-গড়া ও ধ্বংস-সৃষ্টির স্মৃতিকে ধারণ করে আসছে। গোটা বিশ্বের মুসলমানদের চেতনার বেদিতে আশুরা চিরভাস্বর। তবে সময়ের ব্যবধানে ভৌগোলিক অবস্থানভেদে আজ আশুরা আর মহররম চেতনার জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় নিয়ে টিকে আছে।
কোথাও একে স্মরণ করা হচ্ছে শোকের স্মারক হিসেবে। কোথাও তা আনন্দের উপাদান হিসেবে। আবার কোথাও প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে।
আশুরা দিবসকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে ইতিহাসের নানা তথ্য-উপাত্ত ও ঘটনাপ্রবাহ। নবী-রাসুলদের সঙ্গে সম্পৃক্ত আশুরার মর্যাদাবাহী অসংখ্য ঘটনা-উপাখ্যান-বিবরণ ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে খুঁজে পাওয়া যায়।
যেমন আশুরার দিন পৃথিবীর সৃষ্টি, এ দিনেই কেয়ামত, এ দিনে হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি, একই দিনে তার তওবা কবুল হওয়া, এই দিনেই হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জন্মগ্রহণ ও নমরুদের প্রজ্বলিত আগুন থেকে মুক্তি লাভ, হজরত আইয়ুব (আ.)-এর আরোগ্য লাভ, হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পাওয়াসহ অসংখ্য ঘটনার বিবরণ ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
‘মাওজুআতে ইবনে জাওজি’-এর বর্ণনামতে, আশুরার দিনে সংঘটিত ঘটনাবলি বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তা সত্ত্বেও ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সেসব ঘটনার বিশেষ আবেদন রয়েছে বৈকি?
তবে হাদিস শরিফে আশুরার ইতিহাস সম্পর্কে এসেছে, হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা রাখত। তিনি তাদের বললেন, এটি কোন দিন, তোমরা যে রোজা রাখছ? তারা বলল, এটি এক মহান দিন, যেদিন আল্লাহ মুসা (আ.)-কে মুক্তি দিলেন ও ফেরাউনের পরিবারকে ডুবিয়ে মারলেন। তখন হজরত মুসা (আ.) শোকর আদায় করার জন্য রোজা রাখলেন (দিনটির স্মরণে আমরা রোজা রাখি)। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমরা মুসার অনুসরণে তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার। তখন তিনি রোজা রাখলেন ও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। -সহিহ বোখারি : ৩৩৯৭
অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘এটি সেদিন, যেদিন হজরত নুহ (আ.)-এর নৌকা জুদি পর্বতে স্থির হয়েছিল। তাই হজরত নুহ (আ.) আল্লাহর শুকরিয়াস্বরূপ সেদিন রোজা রেখেছিলেন।’ -মুসনাদে আহমাদ : ২/৩৫৯
ইতিহাসের ঘটনা পরম্পরায় ৬০ বা ৬১ হিজরির ১০ মহররম সংঘটিত হয় কারবালার হৃদয়বিদারক, মর্মস্পর্শী ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ। মুজামে কবিরে এসেছে, হজরত জুবাইর ইবনে বাক্কার বলেন, হুসাইন ইবনে আলী (রা.) চতুর্থ হিজরির শাবান মাসের পাঁচ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। আর তাকে আশুরার জুমার দিনে ৬১ হিজরিতে শহীদ করা হয়েছে। তাকে সিনান ইবনে আবি আনাস নাখায়ী হত্যা করে। তাতে সহযোগিতা করেছে খাওলি ইবনে ইয়াজিদ আসবাহি হিময়ারি। সে তার মাথা দ্বিখণ্ডিত করেছে এবং উবাইদুল্লাহর দরবারে নিয়ে এসেছে। তখন সিনান ইবনে আনাস বলেন, ‘আমার গর্দানকে স্বর্ণ ও রৌপ্য দ্বারা সম্মানিত করুন। আমি সংরক্ষিত বাদশাহকে হত্যা করেছি, আমি মা-বাবার দিক দিয়ে উত্তম লোককে হত্যা করেছি।’ -তাবরানি, মুজামে কবির : ২৮৫২
সেদিন পাপিষ্ঠরা যে নির্মমতা ও নির্দয়তার পরিচয় দিয়েছে, তা পাথরসম যেকোনো হৃদয়েই সমবেদনার কম্পন জাগিয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শাহাদাতের পর হজরত হুসাইন (রা.)-এর দেহ মোবারকে মোট ৩৩টি বর্শার এবং ৩৪টি তরবারির আঘাত ছাড়াও অসংখ্য তীরের জখমের চিহ্ন বিদ্যমান ছিল। এ ছাড়া তার সঙ্গে মোট ৭২ জনকে হত্যা করেছে ঘাতকরা।
আশুরার দিন বিশ্বের নানাপ্রান্তের মানুষ মহররম মাসকে বিশেষ করে কারবালার ঘটনাকে স্মরণ করে থাকে। এ দিন অন্যায়, অসত্য ও স্বৈরাচারের কাছে মাথানত না করে হজরত হুসাইন (রা.) সহযোগীদের নিয়ে কারবালার যুদ্ধে শাহাদতবরণ করেন। কারবালার শিক্ষা মুসলমানদেরকে যুগে যুগে অন্যায়, অসত্য ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উৎসাহ যোগায়। এ কারণেই বলা হয়, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায়, হার কারবালা কি বাদ।’ অর্থাৎ ইসলাম প্রতিটি কারবালার পর পুনরুজ্জীবিত হয়।
আমরা জানি, আল্লাহতায়ালা মানুষকে খেলাফতের মহান দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। মানুষ আল্লাহর নির্দেশিত পথে নিজে চলবে এবং অন্যদের পরিচালিত করবে এটাই আল্লাহর অভিপ্রায়। মানুষ দুনিয়াতে তার সামগ্রিক জীবন পরিচালনার জন্য আল্লাহতায়ালা গাইডলাইন তথা পবিত্র কোরআন পাঠিয়েছেন। ইসলাম গ্রহণের পর মুসলমান হিসেবে পরিচিত সবাই সেই জীবন বিধান মেনে চলতে বাধ্য। কিন্তু মানুষ বৈষয়িক বিভিন্ন স্বার্থ ও মানবিক দুর্বলতার কারণে ইসলামের পথ চলা থেকে দূরে চলে যায়। মহররমের শিক্ষা ত্যাগের শিক্ষা। চরম ত্যাগ ও কোরবানি স্বীকার করেই ইসলামের পথে অটল অবিচল থাকতে হবে।