এখন বলতে গেলে প্রায় সবার হাতেই স্মার্টফোন। হাতে হাতে স্মার্টফোনের নানাবিধ ব্যবহার লক্ষণীয়। এর একটি হলো, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় উপস্থিতি। ফলে বাছবিচার ছাড়া সবকিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার অসুস্থ মানসিকতা ব্যাপক হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে প্রচলিত শব্দ হচ্ছে- ‘ভাইরাল করা।’ বিষয়টি রীতিমতো মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে যা মনে চায় তাই বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। মন্দ, ঘৃণিত এমনকি অশালীন অনেক বিষয় কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় অবলীলায় প্রচার করছে।
মন্দ ও অশালীন বিষয় প্রচার এবং তাতে সহযোগিতা করা কবিরা গোনাহ। যারা মন্দ ও অশ্লীল বিষয় প্রচার করে- এমন লোকদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা কোরআন মাজিদে বলেন, ‘স্মরণ রেখো, যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীল বিষয়ের প্রসার হোক- এটা কামনা করে, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে আছে যন্ত্রণাময় শাস্তি এবং আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’ -সুরা নুর : ১৯
সব ধরনের গর্হিত কথা ও কাজের প্রচার এ আয়াতের নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার এই যুগে কোনো কিছু প্রচার করা কিংবা ছড়িয়ে দেওয়া খুব সহজ। চাইলে মুহূর্তেই একটা বিষয় পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেওয়া যায়। নিত্যদিনই নতুন নতুন বিষয় বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে মানুষের মাঝে ছড়িয়েও পড়ছে, এর মধ্যে ভালোর চেয়ে মন্দের পরিমাণই বেশি।
মুসলিম সমাজ এবং পরিবারগুলোতেও এর মাত্রা বেড়ে চলেছে। অনেকে জেনেবুঝে অনাচার ও পাপাচারের দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। অনেকে আবার অসতর্কতায় এ সবে জড়িয়ে পড়ছে। বস্তুত শয়তান গোনাহের কাজগুলোকে লোভনীয় রূপে মানুষের কাছে উপস্থাপন করে, এর মোহে পড়ে বহু মুসলমান নিজেদের দ্বীন-ঈমান ও আখেরাতকে বরবাদ করছে।
কোরআনে কারিমের এ বার্তায় গোনাহ ছড়ানোর সবধরনের মাধ্যমই অন্তর্ভুক্ত। কথায়, লেখায় কিংবা ছবি বা ভিডিও ইত্যাদি বানিয়ে অশালীনতা ছড়ানো নিষেধ। গালিগালাজ করা, মিথ্যা কথা বলা, কাউকে অপবাদ দেওয়া, কারও গীবত করা- এর সবগুলোই মুখের কথায় অশ্লীলতা ছড়ানোর প্রকার। আর সংবাদপত্র ও বই-পুস্তকে মন্দ বা অন্যায় কথা লেখা, চিঠি বা দেয়ালে লেখা কিংবা পোস্টার ও বিলবোর্ডে লেখা অথবা চিত্র আঁকা ইত্যাদির মাধ্যমে অশ্লীলতা ছড়ানোর প্রকার। এসব কিছুই আয়াতের নিষেধাজ্ঞায় শামিল।
ইসলামে গোনাহের কাজ পরিহার করার নির্দেশনা রয়েছে। অন্যের দোষ-ত্রুটির ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষা হলো, অন্যের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যের দোষ গোপন রাখতে বলেছেন। কোন্ দোষ কতটুকু প্রকাশ করা হবে, সে ব্যাপারেও কোরআন-হাদিসে বিস্তারিত নির্দেশনা রয়েছে। ইসলামের এ মহান শিক্ষা ভুলে আমাদের অনেক যুবক ভাই এখন ‘ভাইরাল’-এর রোগে আক্রান্ত, অশ্লীলতা ছড়িয়ে দিতে একে অন্যের সহযোগী। অথচ আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা নেক কাজ ও তাকওয়া অবলম্বনের ক্ষেত্রে একে অন্যের সহযোগিতা করবে, গোনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না। আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহর শাস্তি অতি কঠিন।’ -সুরা মায়েদা : ০২
আল্লাহতায়ালা অন্যত্র ইরশাদ করেন, কিছু মানুষ এমন, যারা অজ্ঞতাবশত আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিচ্যুত করার জন্য এমন সব ‘অবান্তর কথা’ ক্রয় করে, যা আল্লাহ সম্পর্কে উদাসীন করে দেয় এবং তারা আল্লাহর পথ নিয়ে ঠাট্টাবিদ্রূপ করে। তাদের জন্য আছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি। -সুরা লুকমান : ০৬
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, আল্লাহর পথ থেকে এবং ঈমান-আমল থেকে বিচ্যুত করে- এমন যেকোনো কিছু ক্রয় করা আয়াতের নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত।
আজকাল অনেকে বাকস্বাধীনতা, অধিকার ও সৃজনশীলতাসহ নানাবিধ যুক্তির কথা বলে যাচ্ছেতাই করে যাচ্ছে। মুক্তচিন্তা ও প্রগতির নামে কুরুচিপূর্ণ গল্প-উপন্যাস, চিত্রাঙ্কন, ভিডিও, অশিষ্ট ভাষণ-বক্তব্য ও মতবাদ ইত্যাদিকে বিচার বিশ্লেষণ ও দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে বলার চেষ্টা করছে। যদিও এসবের মাধ্যমে সমাজের শিরা-উপশিরায় অনাচার-পাপাচার ছড়িয়ে পড়ছে। সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।
সমাজের সর্বত্র অশালীনতা ও অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ার অনেক মাধ্যম রয়েছে। গল্প-উপন্যাস, সিনেমা-নাটক, ধারণকৃত নানা ধরনের ভিডিও এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া। এসব মিডিয়া প্রায়ই এমন সংবাদ ও ভিডিও প্রচার করে, যা মানুষের জন্য জাগতিকভাবেও নানা দিক থেকে ক্ষতিকর এবং মুসলমানদের জন্য দ্বীন-ঈমানের হন্তারক। অনেকক্ষেত্রে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রসিকতা ও ঠাট্টা-বিদ্রূপও করা হয় এসব মাধ্যমে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
এ সবের বহুমুখী ক্ষতিকর প্রভাবে মুসলমানরা ঈমানি মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলছে। গোনাহের বিষয়গুলোকে হালকাভাবে মনে করছে। ভাইরাল হওয়া ও আলোচনায় থাকার নেশায় প্রভাবিত হয়ে অনেকে তাদের মতো কার্যকলাপে সক্রিয় হওয়ার কথাও ভাবছে। আখেরাতের পরিণতির কথা ভুলে চোখ, কান, হাত, মুখ তথা সর্বাঙ্গ দিয়ে গোনাহে জড়িয়ে যাচ্ছে।
কোরআন-হাদিসের একাধিক জায়গায় বলা হয়েছে, পাপাচারে লিপ্ত হওয়া এবং অন্যদের মধ্যে অশালীনতা ছড়িয়ে দেওয়ার গোনাহের কারণে দুনিয়ার জীবন থেকে আল্লাহর রহমত-বরকত চলে যায়; জীবন হয়ে ওঠে যন্ত্রণাক্লিষ্ট। অসংখ্য হাদিসে এ কথাও বর্ণিত হয়েছে যে, যখন সর্বত্র গোনাহ ও অশালীনতা ছড়িয়ে পড়বে, তখন একের পর এক ফেতনা, বিপদ-দুর্যোগ, মহামারি দেখা দেবে এবং সমাজে অশান্তি-অরাজকতা বিরাজ করবে। কাজেই মুমিনদের এসব বিষয়ে খুব সতর্ক থাকা প্রয়োজন এবং মুসলিম সমাজে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়া সব ধরনের অন্যায়-অশালীনতারোধে চিন্তা-ভাবনা করা ও পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক।