আফ্রিকার কোনো দেশের কথা আলোচনা হলে, মনে হয় হতশ্রী দশাকে সঙ্গী করে গৃহবিবাদে জর্জরিত কিছু মানুষের কথা। উপনিবেশ শাসন পেরিয়ে অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান যাদের নিয়তি। নাইজার এমিই একটি দেশ।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজারের দাপ্তরিক নাম ‘রিপাবলিক অব দ্য নাইজার।’ আফ্রিকার বিখ্যাত নাইজার নদীর নামানুসারে এর নামকরণ হয়েছে। স্থলবেষ্টিত দেশটির উত্তর-পূর্বে লিবিয়া, পূর্বে চাদ, দক্ষিণে নাইজেরিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিমে বেনিন ও বুরকিনা ফাসো, পশ্চিমে মালি, উত্তর-পশ্চিমে আলজেরিয়া অবস্থিত। দেশটির মোট আয়তন চার লাখ ৯০ হাজার বর্গমাইল।
এর ৮০ শতাংশই সাহারা মরুভূমির অংশ। নাইজারের ২৫ মিলিয়ন মানুষের ৯৯.৩ শতাংশই ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের শহর নিয়ামি দেশটির রাজধানী। ৩ আগস্ট ১৯৬০ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে নাইজার।
খ্রিস্টপূর্ব দুই লাখ ৮০ হাজার বছর আগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ১০ হাজার সালে এখানে মানব বসতি গড়ে ওঠে এবং খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ সালের দিকে এখানে কৃষিনির্ভর একটি উন্নত সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়।
নাইজারে ইসলামের ইতিহাস সুপ্রাচীন। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, সাহাবি উকবা বিন আমের (রা.)-এর মাধ্যমে নাইজারে ইসলাম পৌঁছেছিল। অন্যদের মতে, উকবা বিন নাফে (রা.)-এর মাধ্যমে ৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে নাইজারের মানুষ ইসলাম সম্পর্কে জানতে পেরেছিল। বিখ্যাত এই সাহাবি মরু অঞ্চলে বিজয়াভিযান শুরু করেন। ‘কাওয়ার’ শহর বিজয়ের আগ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে।
নাইজারের কাওয়ার শহরটি লিবিয়া সীমান্তে অবস্থিত। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় নাইজারে হিজরি প্রথম শতকেই ইসলামের আলো পৌঁছে গিয়েছিল। কোনো কোনো ঐতিহাসিক দাবি করেন, দেশটির পূর্বে অবস্থিত চাদ হ্রদের আশপাশে বসবাসকারীরাই প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিল। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে অত্র অঞ্চলে ‘কানিম’ রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা তাবে আউয়াল সাব-সাহারান অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
নাইজারে ইসলাম প্রচারে উত্তর আফ্রিকার বারবার মুসলিমদেরও বড় ভূমিকা ছিল। তারা হিজরি অষ্টম শতকে মরক্কো থেকে উত্তর নাইজারের আইরা শহরে বসতি স্থাপন করেছিল। বারবার মুসলিমরা আইরা, তাফিস ও আগাদিস শহরে একাধিক মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে।
আগাদিসে ৪০০ বছর অবস্থানের পর তারা পশ্চিম দিকে হিজরত করে। ১০১০ খ্রিস্টাব্দে অত্র অঞ্চলের সোগনাইয়ের (যা এখন গাউ নামে পরিচিত) শাসক কুঝি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার ইসলাম গ্রহণের পর নাইজারের বিপুলসংখ্যক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে। এভাবে নানামুখী প্রচেষ্টার ফলে খ্রিস্টীয় ১৪ শতকের ভেতর নাইজারের বেশির ভাগ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও দারিদ্র্য নাইজারের মুসলমানদের প্রধান সংকট। এর পরও দেশটিতে ইসলামি কর্মকাণ্ড থেমে নেই। দেশটির আলেম ও ধর্মপ্রাণ মানুষ শিক্ষা, সংস্কৃতি, সেবা ও রাজনীতি সর্বত্রই সক্রিয়। ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত জামিয়া ইসলামিয়া নাইজার দেশটির সর্ববৃহৎ ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তিজানিয়্যা নাইজেরিয়ার প্রধান সুফিবাদী ধারা।
নিয়ামি গ্র্যান্ড মসজিদ দেশটির অন্যতম ইসলামিক স্থাপনা। এটি রাজধানী নিয়ামিতে অবস্থিত বৃহত্তম মসজিদ। ১৯৭০ সালে লিবিয়ার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফির অর্থায়নে মসজিদটি নির্মিত হয়। এটি শহরের অন্যতম চিত্তাকর্ষক এবং মর্যাদাপূর্ণ স্থাপনা। মসজিদের উজ্জ্বল সবুজ গম্বুজ এবং উঁচু মিনার রোদের আলোয় চকচক করে দর্শনার্থীদের মদিনার সবুজ গম্বুজের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
লিবিয়া ছাড়াও নাইজারের বিভিন্ন এলাকায় সৌদি আরব, কাতার ও তুরস্ক মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণ করেছে। ২০২২ সালে একসঙ্গে ৯টি মসজিদ উদ্বোধন করেছে তুরস্ক। তুরস্কের এনজিও আইএইচএইচ হিউম্যানটেরিয়ান রিলিফ ফাউন্ডেশন মসজিদ নির্মাণের পাশাপাশি সৌর বিদ্যুতেরও ব্যবস্থা করেছে।
প্রতিটি মসজিদে কোরআন মাজিদ শিক্ষাদানের জন্য মক্তব প্রতিষ্ঠা এবং উচ্চমানের মাইকিং সিস্টেম ব্যবস্থার পাশাপাশি সেখানে পবিত্র কোরআন ও কার্পেট উপহার দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি মসজিদের ইমামদের জন্য নির্দিষ্ট ভাতারও ব্যবস্থা করেছে আইএইচএইচ হিউম্যানটেরিয়ান রিলিফ ফাউন্ডেশন। এসব মসজিদে নাইজারের হাজার হাজার মুসল্লি ইবাদত-বন্দেগি করেন।