মাফুসি দ্বীপ মালদ্বীপের রাজধানী মালে থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। অল্প সময়ে যাওয়া যায় বিধায় দ্বীপটি অনেকেরই পছন্দের স্থান। এখানে রোমাঞ্চের স্বাদ মিলবে উইন্ড সার্ফিং, কায়াকিং, স্কুবা ডাইভিং ও প্যাডেল নৌকার মাধ্যমে। এর আছে হোয়াইট স্যান্ডি সৈকত ও স্পার্কলিং ওয়াটার। এই নির্জনতার স্বাদ পেতে তীরের অদূরে মাঝে মধ্যে চলে আসে তিমি ও হাঙর। স্পীড বোর্ড বা ফেরিতে দূর থেকে এই দ্বীপটিকে দেখতে অসাধারণ লাগে। যতই কাছাকাছি পৌঁছা যায় ততই যেন এর সৌন্দর্য বাড়তে থাকে।
তবে দ্বীপটির যে বিষয়টি সবার চোখ আটকায়, তা হচ্ছে- জলযান থেকে নামতেই চোখে পড়বে একটি সাইনবোর্ড। তাতে বড় করে ইংরেজিতে লেখা- ATTENTION, NO BIKINI। অর্থাৎ দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন তবে বিকিনি পরিধান করা যাবে না।
জানা গেছে, শুধু মাফুসি দ্বীপেই নয়, মালদ্বীপের অধিকাংশ দ্বীপেই বড় বড় সাইনবোর্ডে লেখা, সাঁতারের ড্রেসে লোকাল এরিয়ায় চলাফেরা নিষেধ, অথবা নো বিকিনি বা আপত্তিকর আচরণ নিষেধ। তবে শুধুমাত্র প্রাইভেট রিসোর্টের প্রাইভেট বীচ এবং কয়েকটি হাতেগোনা কয়েকটি সৈকতে গেলেই বিকিনি পরার অনুমতি মেলে। এখানেও বীচ থেকে উঠে এই পোশাকে লোকাল এরিয়ায় চলাফেরা করা যাবে না। দেশটির সরকারের এমন নির্দেশনা সাবলীলভাবেই মেনে চলে পর্যটকরা। যাদের অধিকাংশই ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ স্বল্প কাপড় পরিধান করা দেশ থেকে আসেন। তারা মালদ্বীপে এসে শতভাগ মুসলিম অধ্যূষিত এলাকার নিয়মকানুন মেনেই দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করেন।
নানাবিধ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ মোকাবেলা করেই পর্যটনকে এগিয়ে নিচ্ছে মালদ্বীপ সরকার। স্বচ্ছ সবুজ পানিতে সাঁতার, বালুময় সৈকতে সূর্যস্নান, প্রবালদ্বীপের বিলাসবহুল রিসোর্টে ছুটিযাপন, স্নোরকেলিং ও স্কুবা ডাইভিংয়ের মতো নানা রোমাঞ্চকর কর্মকাণ্ড বলা যায় পর্যটকদের চাহিদা পূরণে সমস্ত সম্ভার নিয়ে বসে আছে মালদ্বীপ। তাই তো রোমাঞ্চপ্রিয় ও নিরিবিলি আয়েশি অবকাশযাপন সন্ধানী ভ্রমণপিপাসুদের কাছেও পছন্দের এক গন্তব্য ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্র। দেশটির সহজ ভিসানীতি, নিরাপত্তা আর নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশও পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
মালদ্বীপে সহস্রাধিক দ্বীপ আছে, এই দ্বীপগুলোকে দুই নামে ডাকা হয়- লোকাল আইল্যান্ড আর রিসোর্ট আইল্যান্ড। লোকাল আইল্যান্ডে স্থানীয় জনগণ থাকে, তবে পর্যটকদের থাকারও ব্যবস্থা আছে। আর রিসোর্ট আইল্যান্ডে শুধুই রিসোর্ট। ১৯৭২ সালে এমনই একটি দ্বীপে দুটি রিসোর্ট নিয়ে পর্যটনশিল্পের গোড়াপত্তন করে মালদ্বীপ। বর্তমানে দেশটিতে রিসোর্টের সংখ্যা ১৮০। এ ছাড়া আছে হোটেল, গেস্টহাউস ও সাফারি জাহাজসহ নানা কিছু।
মালদ্বীপের পর্যটনের সঙ্গে অনেক দেশেরই কোনো তুলনা চলে না। একসময় মালদ্বীপের মানুষের মূল আয় ছিল মাছ ধরা। সেখান থেকে তারা আজ কোন পর্যায়ে এসেছে সেটা দৃশ্যমান। বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ করে তারা নিজেদের পর্যটন অবকাঠামো তৈরি করেছে। বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে তারা এ পর্যায়ে এসেছে। তাদের সঙ্গে আমাদের একটি বড় মিল রয়েছে, দুই দেশই মুসলিম অধ্যুষিত। তবে এই ধর্ম পরিচয় তাদের উন্নয়নের পথে বাধা হয়নি। তারা রক্ষণশীলতা পাশে রেখেই পর্যটনকে এগিয়ে নিয়েছে। তাদের পর্যটন খাতে বিদেশি বিনিয়োগ এখন ৯৫ ভাগ। যারা বিনিয়োগ করেছে তারাই এর প্রচার করছে। সরকার কখনোই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। তারা পুরো বিষয়টি পেশাদারদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে।
মালদ্বীপে মূলত এককেন্দ্রিক পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সেটি সমুদ্রকেন্দ্রিক পর্যটন। তারা (মালদ্বীপ) এগিয়ে আছে বিদেশি পর্যটকের কারণে। শতভাগ মুসলিম অধ্যূষিত হবার পরও বেশ কিছু ধর্মীয় বিধি নিষেধ থাকার পরও সেখানে পর্যটকরা আসেন। তবে লোকাল এরিয়ার বাইরে তারা বিদেশীদের জন্য কোনো সমস্যার সৃষ্টি করে না। বিশেষ করে বীচ এলাকায় নির্বিঘ্নে পর্যটকরা তাদের সময় ব্যয় করতে পারেন। সেগুলোতে স্থানীয়দের সেভাবে যেতেও দেখা যায় না।
মালদ্বীপ শতভাগ মুসলিম একটি দেশ। এখানে স্থানীয় অধিবাসীরা যেসব দ্বীপে বাস করেন সেখানে ধর্মীয় বিষয়গুলোতে তারা বেশ সচেতন। এরপরেও তারা ধর্মীয় শ্রদ্ধার জায়গাটিকে অটুট রেখেই পর্যটন খাতকে উন্নত করেছে। রিসোর্ট আইল্যান্ডগুলোতে আপনি বিনোদনের জন্য সব করতে পারেন, কিন্তু স্থানীয় দ্বীপগুলোতে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আছে। এ জন্য এখানে লাখ লাখ পর্যটক আসছেন। বিশ্বসেরা যত হোটেল রিসোর্ট ব্র্যান্ড আছে, তাদের প্রত্যেকেরই রিসোর্ট এখানে আছে। প্রত্যেকটি রিসোর্টেই নিজেদের মতো করে পর্যটন ব্যবস্থাপনা রাখার অধিকার রয়েছে। সেখানে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করে না।
মালদ্বীপের সৌন্দর্যে সবাই মুগ্ধ। আর এ কারণে তারকা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই মালদ্বীপ ভ্রমণে ভিড় করেন। বর্তমানে মালদ্বীপ সবারই স্বপ্নের গন্তব্য হয়ে উঠেছে। সারা বছরই এ দেশে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। তবে অত্যন্ত সুন্দর এই স্থানে গিয়েও কিন্তু মানতে হবে কিছু নিয়ম-কানুন। না হলে আপনি বিপদে পড়তে পারে। তাই মালদ্বীপে যাওয়ার কথা পরিকল্পনা করলে প্রথমেই জেনে নিন সেখানে ঘোরাঘুরির সময় কোন কাজগুলো করলে বিপদে পড়বেন। মালদ্বীপের রাস্তায় এমন কাজ করা নিষেধ, যা মানুষকে বিব্রত করবে। এমনকি রাস্তায় হাঁটার সময় গালে চুম্বন করাকেও সেখানে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
মুসলিম দেশ হওয়ায় মালদ্বীপে প্রকাশ্যে মদ খাওয়া নিষিদ্ধ। যদি কোনো দ্বীপের হোটেল বা রিসোর্টে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়। মুসলিম দেশ হওয়ায় মালদ্বীপ গিয়ে জনসমক্ষে বিকিনি বা অতিরিক্ত খোলামেলা পোশাক পরার সুযোগ একেবারেই কম।
শতভাগ মুসলমানের এই দেশের মনেপ্রাণে ধর্মপালন করেন। রাজধানী মালেসহ পাশের বিলিকিলি, হুনহুমালে বা আরেকটু দূরের মাফুশি দ্বীপে গেলেই দেখা মেলে মাথায় স্কার্ফ কিংবা হিজাব পরা মালদ্বীপের মেয়েদের। ভারতীয় মহাসাগরের এই দেশে প্রায় ৯৬ ভাগ নারীই হিজাব পরে রাস্তায় বের হন। মালদ্বীপের নারীদের মধ্যে কেউ পুরো শরীর কালো বোরকায় ঢাকা। কেউ শরীরের ওপরের অংশ ঢেকে রাখেন। কেউবা শরীরের সঙ্গে লেগে থাকা পোশাকের সঙ্গে শুধু মাথায় স্কার্ফ পরেন। শুধু নারীরাই নয়, মালদ্বীপের পুরুষরাও ব্যাপকহারে মসজিদমুখী। মালেতে নামাজের সময় হলেই সব দোকানপাঠ বন্ধ রাখা হয়। আজান হলেই দোকানি দরজার সামনে ‘ক্লোজড’ (বন্ধ) প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে মসজিদে চলে যান।
মালে শহরে কিছু নারী আধুনিক পোশাক পরলেও দ্বীপগুলোতে হিজাব ছাড়া কোনো নারী তেমন দেখা যায় না। মালদ্বীপের মেয়ে বা মায়েরা সমুদ্র বিচে নামলেও বোরকা পরেই নামেন। পশ্চিমা দেশের পর্যটকরা এই দেশে এসে স্বল্প পোশাক পরেই নেমে পড়েন সাগরে। তবে মালেতে এই স্বল্প পোশাক পরে কেউ বিচে যেতে পারবে না। বিশেষ করে নারীরা। বিচের পাশে লেখা সাইনবোর্ডে- ‘নো বিকিনি’।
প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের পাশাপাশি মুসলমানদের ইবাদত-বন্দেগির জন্য মালদ্বীপে রয়েছে ছোট বড় অনেক মসজিদ। তবে রাজধানি মালেতে মসজিদের সংখ্যা বেশি। ২০১৮ সালে মালেতে উদ্বোধন করা হয় মালদ্বীপের সবচেয়ে বড় মসজিদ কিং সালমান মসজিদ। নান্দনিকতায়ও এটি অদ্বিতীয়। এ মসজিদে একসঙ্গে ১০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন।