উজবেকিস্তান মধ্য এশিয়ার একটি বৃহৎ প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ১৯২৪ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালের ৫ ডিসেম্বর গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
রুক্ষ ও শুষ্ক দিগন্ত বিস্তৃতি মরুভূমি এবং বড় বড় পাহাড়-পর্বত আর এ দেশের বিশাল অংশ দখল করে আছে। উজবেকিস্তানে বৃষ্টিপাত তেমন একটা হয় না। গরমকালে উত্তাপ বহু গুণে বেড়ে যায়, আর শীতের মৌসুমে শূন্যের বেশ নিচে নেমে আসে পারদ।
সিআইএর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী উজবেকিস্তানের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রধান ধর্ম ইসলাম। ৩০ হিজরিতে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান (রা.)-এর আমলে হজরত আহনাফ বিন কায়েস (রা.) এ অঞ্চলে ইসলাম-প্রচার অভিযানে আসেন এবং পারস্য বিজয়ের পর উজবেকিস্তানে মৌলিকভাবে ইসলামের আগমন হয়।
দেশটির রাষ্ট্রীয় ভাষা উজবেক হলেও মুসলমানরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরবি ও ফার্সি ব্যবহার করে। আরবি বর্ণে একসময় উজবেক ভাষা লেখা হতো। পর ইতিহাসের চড়াই-উৎরাইয়ে তাতে পরিবর্তন আসে।
উজবেকিস্তানে প্রচুর ঐতিহাসিক মসজিদ, স্থাপনা ও প্রাচীন সমাধি রয়েছে। দেশটির শতশত ধর্মীয় স্থাপনা বিদেশি পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্য। এরই একটি হলো- উজবেকিস্তানের বোখারার ঐতিহ্যবাহী স্থান ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন চাশমা-ই-আইয়ুব।
বোখারা শহরে অবস্থিত ইসমাইল সামানির সমাধিক্ষেত্র এবং শহরের ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন নগরপ্রাচীরের কাছেই এর অবস্থান। ধারণা করা হয়, নবী হজরত আইয়ুব (আ.) এই স্থান পরিদর্শন করেন এবং তার সহচরদের নিয়ে একটি কূপ খনন করেন। এখনো ওই কূপের পানি সুপেয়।
উজবেকিস্তানের মানুষ এই কূপের পানিতে আরোগ্য আছে বলেই বিশ্বাস করে। কূপের পাশেই একটি সমাধিসৌধ রয়েছে, যা আমির তৈমুরের যুগে নির্মাণ করা হয় এবং তাতে খাওয়ারিজম স্থাপত্যরীতি অনুসরণ করা হয়। ১৮ জানুয়ারি ২০০৮ ইউনেসকো চাশমা-ই-আইয়ুব বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে।
চাশমা-ই-আইয়ুব একটি সমাধিক্ষেত্রও বটে। অনেকের বিশ্বাস এখানে হজরত আইয়ুব (আ.)-এর কবর রয়েছে। সমাধিক্ষেত্রে কয়েক শ বছরের পুরনো স্থাপনা আছে। সমাধিক্ষেত্রের সবচেয়ে পুরনো অংশ খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত। এখানে ১৩৮০ খ্রিস্টাব্দের একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে।
খ্রিস্টীয় ষষ্ঠদশ শতাব্দীর আরেকটি শিলালিপির বর্ণনা অনুসারে আমির তৈমুরের খাওয়ারিজম অভিযানের সময় তা নির্মাণ করা হয়। উজবেকিস্তানের একাধিক বরেণ্য মনীষীকে চাশমা-ই-আইয়ুব সমাধিক্ষেত্রে দাফন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ধর্মতাত্ত্বিক ও মুহাদ্দিস খাজা হাফেজ গুনজারি (রহ.) অন্যতম। তাকে ১০২২ খ্রিস্টাব্দে দাফন করা হয়।
হজরত আইয়ুব (আ.)-এর স্মৃতিধন্য ঐতিহাসিক এই স্থানে স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেন তৈমুর যুগের আমির হাজ্জাজ। সাইবানীয় শাসক দ্বিতীয় আবদুল্লাক্সনের (মূল নাম আবদুল্লাহ বিন ইস্কান্দার) যুগে সমাধিক্ষেত্রের সংস্কার, আধুনিকায়ন ও নির্মাণকাজ শেষ হয়।
চাশমা-ই-আইয়ুবের প্রধান প্রবেশপথ পূর্বমুখী। এখানে একটি বিশেষ কক্ষ রয়েছে, যার ভেতর হজরত আইয়ুব (আ.)-এর পদচিহ্ন বা কবর আছে। কক্ষের ভেতর একটি কাঠের বোর্ডে হজরত আইয়ুব (আ.)-এর বোখারা সফরের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।
সোভিয়েত শাসনামলে অন্যান্য ইসলামি স্থাপত্যের মতো চাশমা-ই-আইয়ুবও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উজবেকিস্তান সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মুক্ত হওয়ার পর সমাধিক্ষেত্র সংস্কার করা হয়।
বলা হয়, হজরত আইয়ুব (আ.) যখন বোখারায় গমন করেন তখন সেখানে ভয়াবহ পানির সংকট চলছিল। বহু মানুষ ও পশুপাখি তৃষ্ণায় মারা যাচ্ছিল, তার অনুসারীরাও তৃষ্ণায় কষ্ট পাচ্ছিল। হজরত আইয়ুব (আ.) আল্লাহর নামে শুষ্ক মাটিতে আঘাত করলে মাটি ফেটে পানি উঠতে শুরু করে। এটা ছিল আল্লাহর কুদরত ও হজরত আইয়ুব (আ.)-এর মুজিজা। পরবর্তী সময়ে এই কূপ কেন্দ্র করেই বোখারা শহরের গোড়াপত্তন হয়।
ইসলামি শাসনামলে বোখারা ছিল বিশ্বের সুন্দরতম নগরীগুলোর একটি এবং মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রধান জ্ঞানকেন্দ্র। সুফি আলেমরা মনে করেন, এটা ছিল হজরত আইয়ুব (আ.)-এর পদচিহ্নের বরকত। এখনো চাশমা-ই-আইয়ুবের চারপাশের সজীবতা আল্লাহর অনুগ্রহের কথা ও নবী হজরত আইয়ুব (আ.)-এর বরকতের কথা মনে করিয়ে দেয়।
বর্তমান সমাধিসৌধটি অনেকটাই সাদাসিধে ও সাজসজ্জাহীন। মূল সমাধিসৌধটি এক কক্ষবিশিষ্ট। এর ওপরে আছে চারটি গম্বুজ। যার প্রত্যেকটি ভিন্ন ভিন্ন শাসকের শাসনামলে নির্মিত হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন কাঠামো ও নির্মাণশৈলী একেকটি যুগের প্রতিনিধিত্ব করে। মূল গম্বুজটি তাঁবুর মতো। মূল কক্ষ ছাড়াও সেখানে আলো-আঁধারির রহস্যে ঘেরা ছোট ছোট কয়েকটি কক্ষ আছে, যাতে একই সঙ্গে রহস্য ও আধ্যাত্মিকতার ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
বর্তমানে চাশমা-ই-আইয়ুবে একটি জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে, যাতে বোখারা শহরের পানি সরবরাহের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। জাদুঘরে ১৮-১৯ শতকে নির্মিত পানির পাইপ, তামার পাইপ এবং ১৯-২০ শতকে নির্মিত পানির মশক (চামড়ার তৈরি পানির পাত্র) প্রদর্শন করা হয়েছে। এর বিপরীত আছে ইমাম বোখারি (রহ.) কমপ্লেক্স। যাকে বোখারার সবচেয়ে বিখ্যাত মনীষী মনে করা হয়। তার রচিত সহিহ বোখারি বিশুদ্ধতম হাদিসগ্রন্থ হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত।
বিবিসির তথ্য মতে, পর্যটনশিল্পের উন্নতির মাধ্যমে উজবেকিস্তান ‘দ্বিতীয় মক্কা’ হতে চায়। দেশটির সরকার মনে করে, দেশটির শতশত ধর্মীয় স্থাপনার মাধ্যমে বিদেশি পর্যটকদের কাছে আরো আকর্ষণীয় করে তুলে ধরা সম্ভব।