দোকান কর্মচারি থেকে মসজিদে নববির ক্যালিগ্রাফার হওয়ার গল্প

মদিনা, ইসলাম

ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম | 2024-12-24 21:21:30

‘যখন নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজায় আমার হাতেলেখা ফলকগুলো স্থাপন করা হয়, তখন আমার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। আমি একনজরে সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম, আমার গলার স্বর শুকিয়ে যায়, আমার ভেতরে একটি ঝড় বইতে থাকে।’

এভাবেই পাকিস্তানি ক্যালিগ্রাফার শফিক-উজ-জামান বলছিলেন তার অনুভূতির কথা। রওজা শরিফে স্থাপিত কোরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফিসমৃদ্ধ তিনটি ফলকই তার হাতে লেখা।

পবিত্র রওজায় স্থাপিত কোরআনে কারিমের আয়াতের ক্যালিগ্রাফিসমৃদ্ধ ফলকগুলো যেকোনো জিয়ারতকারীকেই মোহিত করে। এই কাজে লেগেছে দেড় বছর। প্রতিটি ফলক তৈরিতে ছয় মাস সময় লেগেছে। এগুলো ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া। মসজিদে নববির দরজা ও সেখানে স্থাপিত অফিসগুলোর বোর্ডের নামফলকগুলোও তার লেখা।

মসজিদে নববি মানে সবুজ গম্বুজের ছায়া। স্বর্গীয় সৌরভে মৌতাত আঙিনা। নবী কারিম (সা.)-এর রওজা মোবারক। অনিন্দ্য সুন্দরের মায়ামাখা প্রাঙ্গণ। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ নিরন্তর স্বপ্ন দেখেন মসজিদে নববির সান্নিধ্য-পরশে জীবন কাটানোর। কিন্তু এমন সৌভাগ্য কয়জনের জীবনে জুটে?

রওজার সামনে স্থাপন করা হচ্ছে শফিক-উজ-জামানের ক্যালিগ্রাফি, ছবি: সংগৃহীত

তবে কেউ যদি মসজিদে নববির গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজেই ৩৬ বছর কাটান স্বর্গীয় এ পরিবেশে! তাহলে নিশ্চয় ভাবতেই অবাক লাগে।

কিন্তু ঠিক এমন কাজটি করার দুর্লভ সৌভাগ্য লাভ হয়েছে উস্তাদ শফিক-উজ-জামানের। বিগত তিন যুগ অর্থাৎ ৩৬ বছর ধরে তিনি মসজিদে নববির একজন একনিষ্ঠ আরবি ক্যালিগ্রাফার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।

শফিক-উজ-জামানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা পাকিস্তানে। বর্তমানে জিয়ারতে গেলে মসজিদে নববির ভেতরের পিলারগুলোতে বিভিন্ন রকমের শিল্পলিপি দেখা যায়। যার বেশিরভাগই করেছেন শফিক উজ জামান।

শফিক-উজ-জামান সৌদিতে যাওয়ার পর সর্বপ্রথম রিয়াদের একটি দোকানে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর তার সামনে আসে জীবন পরিবর্তনের সুবর্ণ সুযোগ। আর সুযোগটি লুফে নিতে তিনি ন্যূনতম দেরি করেননি। সৌদি আরবভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘বেস্ট ক্যালিগ্রাফার ফর হারাম’ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পর তার জীবন সম্পূর্ণরূপে বদলে যায়। নেমে আসে অনাবিল সুখ-শান্তির বারিধারা।

রাসুলের রওজায় শফিক-উজ-জামানের ক্যালিগ্রাফি, ছবি: সংগৃহীত

১৯৯০ সালে মসজিদে নববি নির্মাণ কাজের তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা একটি ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতার ঘোষণা দেয়। প্রতিযোগিতার লক্ষ্য ছিল এমন একজন ক্যালিগ্রাফার খুঁজে বের করা, যে তুর্কি যুগের ক্যালিগ্রাফি কাজ সংশোধন করতে পারেন।

বিশ্বের চার শ জন বিখ্যাত বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার অংশগ্রহণ করেন। প্রতিযোগিতার বিচারকরা যখন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন, তখন লোকেরা ভেবেছিল নির্বাচিত ক্যালিগ্রাফার হবেন একজন আরবি। কিন্তু দেখা গেলো, তিনি আরবি নন- পাকিস্তানি।

শফিক-উজ-জামান মসজিদে নববিতে ক্যালিগ্রাফির জন্য নির্বাচনকে আল্লাহতায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ বলে অভিহিত করেছেন।

আরব নিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ক্যালিগ্রাফি শিল্প আল্লাহর দান। এটা আমি কারও কাছ থেকে শিখিনি।

তিনি বলেন, মদিনায় ক্যালিগ্রাফি করে আমি যে শান্তি পাই, তা আর কোথাও পাই না। আল্লাহর কাছে শোকরিয়া জানাই যে, এখানে ক্যালিগ্রাফি করার সুযোগ পেয়েছি- আমার আর কি দরকার?

শৈশব থেকে স্বচ্ছন্দ্যে ক্যালিগ্রাফি করলেও তিনি বিশ্বাস করেন, গত ৩৬ বছর তার জীবনের বর্ণোজ্জ্বল সময়। এর মাধ্যমে তিনি নিজের জীবনে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনেছেন। এ দীর্ঘ সময় ধরে তিনি মসজিদে নববির একজন নিষ্ঠাবান ও চৌকস ক্যালিগ্রাফর হিসেবে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

শফিক-উজ-জামানের ক্যালিগ্রাফি, ছবি: সংগৃহীত


শফিক-উজ-জামান ১৭৭টি গম্বুজেও কাজ করেছেন। তিনি বলেন, আমি তুর্কি ক্যালিগ্রাফার উস্তাদ হামিদ আল-আমাদির শিল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত। আপনি আমাকে তার আধ্যাত্মিক শিষ্য বলতে পারেন।

তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র মসজিদে কাজ করতে পারাটা তাকে শান্তি-সমৃদ্ধি ও অপার সুখ এনে দিয়েছে। আঁকাআঁকির কাজগুলো করতে বেশ সময় লাগলেও তিনি কাজটি বেশ উপভোগ করেন। নিপুণতার স্বাক্ষর রেখে এতে সৌন্দর্যের পালক লাগিয়ে দেন।

বস্তুত এটি গৌরবোজ্জ্বল মর্যাদাপূর্ণ ও অপূর্ব সম্মানের। এখন মসজিদে নববির দেয়ালে দেয়ালে তার শিল্প ও কর্ম-কুশলতা দেখা যায়। এভাবে কাজ করে শাফিক-উজ-জামান মহান আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চান বলে জানান।

এ সম্পর্কিত আরও খবর