বিশ্বকাপ আসর: চাই জাগ্রত বিবেকের শুভ বোধোদয়

, ইসলাম

মুফতি মাহফূযুল হক, অতিথি লেখক, ইসলাম, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 21:16:32

ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ যৌক্তিক একটি জীবন বিধান। প্রয়োজনীয় কোনো কিছু নিয়ে প্রয়োজনাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এতে নেই। আবার প্রয়োজনীয় কোনো কিছু প্রয়োজন পরিমাণ গ্রহণ না করার কড়াকড়িও এতে নেই।

সুস্বাস্থ্যের জন্য এবং দেহের কর্মক্ষমতা ও কর্মচাঞ্চল্যতা ধরে রাখার জন্য শরীরচর্চার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আবার খেলাধুলা শরীরচর্চার অন্যতম একটি উপাদান। এ বিবেচনা ও প্রয়োজনে ইসলাম খেলাধুলাকে অনুমোদন দেয় বা আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলা যেতে পারে ইসলাম খেলাধুলাকে উৎসাহও দেয়। কিন্তু ইসলামের আদর্শ ও স্বভাব হলো- ইসলাম প্রয়োজনকে মেনে নেয়। তবে প্রয়োজনাতিরিক্ত বাড়াবাড়িকে মেনে নেয় না।

যখনই খেলাধুলা হয়ে যাবে জীবনের আসল লক্ষ্য, খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড তখন যুক্তি ও স্বভাব বিরোধী এ ব্যবস্থাকে ইসলাম মেনে নেয় না।

খেলাধুলা হবে আসল কাজ, খেলাধুলাকে কেন্দ্রকরে সব কিছু আবর্তিত হবে এটা শিশুদের জন্য শোভণীয়। কিন্তু যার বয়সের পরিপক্কতা এসেছে, যার মস্তিষ্কের ও চিন্তাশক্তির পরিপক্কতা এসেছে দেশ ও জাতিকে যার দেওয়ার আছে অনেক কিছু- সে তো আসল কাজ ফেলে রেখে সারাদিন বা দিনের উল্লেখযোগ্য অংশ খেলায় মেতে থাকতে পারেন না।

সময় ও অর্থ এ দু’টি বস্তুকে ইসলাম মানবজীবনের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ আখ্যা দিয়েছে। ইসলাম এ দু’য়ের যথেচ্ছা ব্যবহার ও অহেতুক অপচয়ের ঘোর বিরোধী। মানবজীবনে সময়ের গুরুত্ব বুঝাতে যেয়ে কোরআনে কারিমে ‘আল আসর’ নামে একটি সূরাই অবতীর্ণ হয়েছে। এ সূরার শিক্ষা হলো, সময়ের সুষ্ঠু ব্যবহার মানবজীবনকে সফল করে আর সময়ের অপচয় বিশ্বমানবতার জন্য মহাধ্বংসের কারণ, বিশাল ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কোরআনে কারিসে সম্পদের অপচয়কারীকে বলা হয়েছে শয়তানের দোসর। কিয়ামতের মাঠে যে কয়টি প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য উত্তর দেওয়া ব্যতীত এক পা অগ্রসর হওয়া যাবে না, সেগুলোর মধ্যে একটি প্রশ্ন হলো- সময় কোথায় কিভাবে ব্যয় করা হয়েছে। আরেকটি প্রশ্ন হলো- অর্থ কোথায় কিভাবে ব্যয় করা হয়েছে।

উপরোক্ত তিন কারণে আধুনিক বিশ্বের খেলাধুলার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব আয়োজনগুলোকে ইসলাম প্রত্যাখ্যান করে এবং অস্বীকার করে। কোনো মানুষ বা কোনো গোষ্ঠী খেলাধুলাকে জীবনের উদ্দেশ্য বানাবে ইসলাম তা মেনে নেয় না। খেলাধুলার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আয়োজনের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ও কোটি কোটি কর্মঘণ্টার অপচয়ের যে মহাব্যাবস্থাপনা করা হয় ইসলাম তা মেনে নেয় না।

খেলাধুলার দেশিয় বা আন্তর্জাতিক আয়োজন সমর্থন করা এবং উপভোগ করা নাজায়েজ হওয়ার জন্য উপরোক্ত তিনটি কারণের পরে আর কোনো কারণ থাকার প্রয়োজন নেই।

কিন্তু খেলাধুলার আন্তর্জাতিক ও দেশিয় আয়োজনগুলোতে উপরোক্ত মৌলিক তিনটি বড় সমস্যা থাকার পাশাপাশি রয়েছে মদ, জুয়া ও পতিতাবৃত্তির জটিল সংমিশ্রণ। আন্তর্জাতিক আসরগুলো চলার সময় বিশ্বমিডিয়াতে চোখ রাখলে মদ, জুয়া ও পতিতাবৃত্তির ভয়াবহ তুফানের পিলে চমকানোর মতো তথ্য পাওয়া যায়। পরিস্থিতি ও বাস্তবতা এটাই যে, আন্তর্জাতিক আসরগুলোকে মদ, জুয়া ও পতিতাবৃত্তির সংমিশ্রণ থেকে মুক্ত করা আদৌ সম্ভব নয়। এমনকি তা কল্পনাও করা যায় না। খেলাধুলার একেকটি আসর আর মদ, জুয়া ও পতিতাবৃত্তি হলো- টাকার এপিঠ-ওপিঠমাত্র।

তাই এ পরিস্থিতে খেলাধুলার আন্তর্জাতিক আসরগুলোর প্রতি আগ্রহ ও সমর্থন প্রকাশ করার দ্বারা মদ, জুয়া ও পতিতাবৃত্তির প্রতি নিজের সমর্থন ও অবস্থান জানান দেওয়া হয়। অর্থ ও সময় অপচয়ের পালে হাওয়া দেওয়া হয়। খেলাধুলাকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ সব সমর্থন ও স্বীকৃতি কোনো ঈমানদারের পক্ষে সম্ভব নয়।

পবিত্র হাদিসের ভাষ্যমতে, যে ব্যক্তি কারও দল ভারি করবে- সে তাদেরই মধ্যে গণ্য হবে। আগ্রহের সঙ্গে বিশ্বকাপ আসরের খেলা দেখা, খেলা নিয়ে মতবিনিময় করা, কোনো দলকে পছন্দ করা, পছন্দের দলের পতাকা-জার্সি ব্যবহার করা ইত্যাদির দ্বারা ওদেরকেই ভারি করা হবে। তাই আল্লাহর কাছে দায়মুক্তি জন্য অবশ্যই কথা ও কাজে বিশ্বকাপ খেলার প্রতি সর্বপ্রকার সম্পর্কহীনতা পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করা আবশ্যক।

খেলোয়াড় মুসলিম নাকি অমুসলিম, খেলোয়াড়দের সতর আবৃত নাকি অনাবৃত, নামাজের ক্ষতি হচ্ছে কিনা, কুদৃষ্টি হেফাজত করা সম্ভব হচ্ছে কিনা তুলনামূলকভাবে এগুলো অনেক ছোট ইস্যু। প্রধান সমস্যা হলো- আগেরগুলো।

একটি আসরের আগমন উপলক্ষ্যে চারদিকে যেভাবে বিদেশি পতাকা উড়ানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে- এতে জনগণ কী পরিমাণ টাকার অপচয় করছে তার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের হাতে না থাকলেও কিছুটা আন্দাজ করা যায়।

খেলা চলাকালীন সারাদেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কার্যতঃ কোনো পড়াশোনা থাকে না। সরকারি, বেসরকারি সব অফিস-আদালতে কাজে একটা স্থবিরতা বিরাজ করে। সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু থাকে চলমান খেলা। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনি-গরিব, প্রবীণ-তরুণ, চাকুরে-বেকার সবার নিমগ্নতা ও সম্পৃক্ততা দেখলে মনে হয় দেশের কোনো সমস্যা নেই। দেশের মানুষের আর কোনো কাজ নেই।

ফুটবল বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না থাকলেও ক্রিকেট বিশ্বকাপে আছে। সেখানে ভালো পারফরমেন্স দেখাতে পারলে খেলোয়াড়কে যেভাবে যত্ন করা হয়, পুরষ্কৃত করা হয়, সমাদর করা হয়- তা যদি দেশের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া, গবেষণা করে যাওয়া সফল বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে করা হতো- তাহলে উন্নয়নের পথে দেশ বহুদূর এগিয়ে যেতো। একটা ছক্কা, একটা ক্যাচ, একটা গোল জাতীয় জীবনে সামান্যতম কোনো দরকারি বস্তু নয়। এগুলো মনোরঞ্জনের বিষয়, বলার বিষয়। এসব ছাড়াও দেশে চলে বা চলবে।

আমরা মনে করি, জাতির প্রয়োজন একজন বিজ্ঞানীর। জাতির প্রয়োজন এমন বিজ্ঞানীর যার আবিষ্কার দেশের কৃষিতে বিপ্লব সাধন করবে। জাতির প্রয়োজন এমন বিজ্ঞানীর যার আবিষ্কার দেশের চিকিৎসায় বিপ্লব সৃষ্টি করবে। জাতির প্রয়োজন এমন বিজ্ঞানীর যার আবিষ্কার দেশের যোগাযোগ খাতে মহাবিপ্লব ঘটাবে। সুতরাং বাজেটে এমন মেধাবি উদ্ভাবকদের সুযোগ সুবিধা ও গবেষণার পেছনে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। তাহলে আমাদের সোনার বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে আরও বহুদূর। আমার সেই সোনার বাংলা দেখার অপেক্ষায়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর