রমজানের ২৪তম তারাবিতে তেলাওয়াত করা হবে ২৭তম পারা অর্থাৎ সূরা যারিয়াতের ৩১ নম্বর আয়াত থেকে সূরা হাদিদের শেষ পর্যন্ত। এ তারাবির অতিব গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গগুলোর একটি হলো দুনিয়ার জীবনের অসারতা ও ক্ষণভঙ্গুরতার দৃশ্যায়ন।
আজকের তারাবিতে শোনানো হবে, ‘তোমরা জেনে রাখো, পার্থিব জীবন ছেলেখেলা, ক্রীড়া, সাজ-সজ্জা, পারস্পরিক অহমিকা এবং ধন ও জনের প্রাচুর্য ব্যতীত আর কিছু নয়। যেমন এক বৃষ্টির অবস্থা, যার সবুজ ফসল কৃষকদের মুগ্ধ করে, এরপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পাও, এরপর তা খড়কুটো হয়ে যায়। আর পরকালে আছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ বৈ কিছু নয়। তোমরা এগিয়ে যাও তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে, যা আকাশ ও পৃথিবীর মত প্রশস্ত।’ -সূরা হাদিদ: ২০-২১
মোটাদাগে মানুষের জীবনের দু’টি ধাপ। দুনিয়া ও আখেরাত। দুনিয়ার জীবনের আবার কয়েকটি ধাপ। শিশুকালে মানুষ অকারণেই ছুটাছুটি করে বেশি, লক্ষ্যহীন, উপকারহীন সব খেলাধুলায় নিমগ্ন থাকে। মিছেমিছি রান্নাবান্না খেলে এমনকি মিছেমিছি সংসারও খেলে। সেই সময়ে মানুষের কাছে এ সকল ছেলেখেলাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে হয়। এতে সামান্য ব্যত্যয় ঘটলে তখন মানুষ তা মেনে নিতে পারে না। কান্নাকাটি করে সব একাকার করে ফেলে। কিন্তু বয়স বেড়ে যখন কিশোর হয় তখন শৈশবের অকারণের সব খেলাধুলার অসারতা মানুষের বুঝে আসে। তখন মিছেমিছি রান্না খেলা পণ্ড হওয়াতে মনে ব্যথা লাগে না। বরং শিশুকালের কাজ কারবারকে পাগলামি মনে হয়। তখন মানুষের কাছে গুরুত্ব পায় উপকারী খেলাধুলা। ফুটবল, ক্রিকেট, হা-ডু-ডু, সাঁতার ইত্যাদি খেলাতে জীবনের স্বার্থকতা বুঝে আসে। লেখাপড়া, নাওয়া-খাওয়া, টুকিটাকি কাজ সব কিছুকে একপেশে ফেলে রেখে খেলার বিশাল মাঠে, পাতানো ম্যাচে নিজেকে নিমগ্ন রাখতে পছন্দ করে।
কিন্তু বয়স আরেকটু বেড়ে যখন তারুণ্যে পদার্পণ করে তখন খেলার মাঠ আর ম্যাচের আগ্রহে ভাটা পড়ে। তখন মানুষের নিমগ্নতা বাড়ে সাজসজ্জার প্রতি। ছেলে হোক আর মেয়েই হোক নিজের সাজগোজের প্রতি ঝোঁক বাড়ে। এটাতেই জীবনের স্বার্থকতা মনে হতে থাকে। খেলার আসরের হৈ-চৈকে অযথা মনে হয়। কিন্তু ভরাট যৌবনে সাজগোজের প্রতিও মানুষ আসক্তি হারিয়ে ফেলে। এগুলোকে অর্থহীন অহেতুক মনে হতে থাকে। তখন মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়ে অহমিকার প্রদর্শন নিয়ে। দুনিয়ার বিভিন্ন কিছু নিয়ে অন্যের ওপর অহমিকা দেখানোর নেশায় নিমগ্ন হয়ে যায়। কিন্তু জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে তখন পেয়ে বসে ধনের পাচুর্যতার নেশা। সহায় সম্পদ, জায়গা-জমি, ব্যাংক-ব্যালেন্স বেশি বানানোর লোভ মানুষকে পেয়ে বসে।
দুনিয়াতে জীবনের প্রতিটি ধাপে এসে আগের ধাপের লক্ষ্যকে যেভাবে অসার মনে হয়, অহেতুক মনে হয়, ফালতু মনে হয় ঠিক সেভাবেই দুনিয়ার ধাপ পাড়ি দিয়ে আখেরাতের ধাপে এসেও দুনিয়ার সব কিছুকে অসার, অহেতুক, ফালতু মনে হবে। ৩০ বছরের যুবকের কাছে যেভাবে ৬ বছরের বাচ্চার লক্ষ্যহীন খেলার কোনো গুরুত্ব নেই, ৬০ বছরের বৃদ্ধের কাছে যেভাবে ১৯ বছরের তরুণের সাজসজ্জার কোনো গুরুত্ব নেই ঠিক তেমনিভাবে কবরবাসীর কাছে এ জীবনের জয়-পরাজয়ের, সুখ-অসুখের কোনো গুরুত্ব নেই।
সময়ের পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ বস্তু যে গুরুত্ব হারায় তা উদাহরণ দিয়ে বুঝাতে যেয় মহান আল্লাহ ফসলের উদাহরণ দিয়েছেন। এক সময়ের ধান, গমের সবুজ গাছগুলো কৃষকের কাছে কত বেশি গুরুত্ব পায়, কিন্তু কয়েক দিন পরেই যখন তা হলদে হয়ে খড়কুটোয় পরিণত হয় তখন তা কৃষকের কাছে আর কোনো গুরুত্ব পায় না। গুরুত্বহীন মূল্যহীন হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে, মাটিতে মিশে যেতে থাকে। ঠিক অনুরূপভাবে যা এ জীবনে গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে তা আমাদের কাছে চরম গুরুত্বহীন, মূল্যহীন হয়ে পড়বে।
দুনিয়ার জীবনের সবকিছুর মূল্যায়ন মহান আল্লাহ এক কথায় এভাবে বলেছেন, ‘পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ বৈ কিছু নয়।’
কেননা, যাকে দরকারী, উপকারী মনে হতে থাকে কিন্তু দেখা গেল আসল দরকারের সময় তা কোন কাজে আসল না তবে তা তো প্রতারণাই। মানুষের চূড়ান্ত বিপদের দিনে, পরকালের আজাবের সামনে দুনিয়ার ধনসম্পদ মানুষের কোনো উপকার করতে পারবে না অথচ মানুষ নিজের বিপদের দিনে কাজে আসার জন্যই এগুলো সঞ্চয় করে থাকে।
এভাবে দুনিয়ার অসারতা, ক্ষণভঙ্গুরতার দৃশ্যায়নের পর মহান আল্লাহ বলছেন, ‘আল্লাহর ক্ষমা ও জান্নাত লাভের প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার চেষ্টা করো।’