রান্নাবিষয়ক জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় দ্বিতীয় রানার আপ হয়েছেন কিশোয়ার চৌধুরী। গত এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এ শোতে অংশ নিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। কিশোয়ার যখন চমক দেখিয়ে গ্রান্ড ফিনালে পৌঁছে যান, তখন বাধে বিপত্তি!
বাংলাদেশি গণমাধ্যম কিশোয়ারকে ‘বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী’ বলে পরিচয় করিয়ে দিলেও ভিন্নপথে হাঁটে ভারতীয় গণমাধ্যম। দেশটির গণমাধ্যমে কিশোয়ার চৌধুরীকে ভারতীয় বলে উল্লেখ করা হয়।
দু’দেশের মিডিয়া যাই দাবি করুক—কিশোয়ারের পরিচিতি বাঙালি রান্নায়। একের পর এক বাঙালি রান্না দিয়ে শো-এর বিচারকদের মন জিতে নিয়েছেন তিনি। গ্রান্ড ফিনালে দ্বিতীয় রানার আপ হলেও তিনি মন জয় করেছেন বাঙালিদের। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামে এখন কিশোয়ারকে নিয়ে বাঙালিদের উৎসাহ-উদ্দীপনা।
কিশোয়ারের বাবা ঢাকার বিক্রমপুরের বাসিন্দা ছিলেন। আর মা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের। প্রায় ৫০ বছর আগে তারা অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। তবে পারিবারিক আবহে বাঙালিয়ানা ভোলেননি তারা। মেয়ে কিশোয়ারকে গড়ে তুলেছেন বাঙালি মননে। ফলে মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় বাঙালি খাবারে বাজিমাত করলেন কিশোয়ার।
বাছাই পর্বে মাছ আর কাঁচা আমের রেসিপির পর একের পর এক বাংলাদেশি খাবার মাস্টারশেফের মঞ্চে তুলেছেন কিশোয়ার। এরপর রান্না করেছেন টমেটো এবং পুদিনা পাতা দিয়ে পাস্তা, টমেটো দিয়ে মাছের ঝোল, শিমের ভর্তা আর জিরা ভাত, গলদা চিংড়ি ভাজা, বিটরুট সবজি, শসা দিয়ে মাছ ভাজা, ফুচকা, চটপটি, সমুসা, দম-আলু আর তেঁতুল চাটনি, রেঁধেছেন খিচুড়ি, বেগুন ভর্তা আর নিরামিষ ভোজ, খাসির রেজালা আর ঘিয়ে ভাজা পরোটা, নেহারি এবং পান্তা-‘ইলিশ’ আর আলুভর্তার মতো বাঙালি খাবার। প্রতিবারই খাবারগুলো বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবার সেটি উল্লেখ্য করেছেন কিশোয়ার।
৩৮ বছর বয়সী কিশোয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যের মেলবোর্নের বাসিন্দা। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা অস্ট্রেলিয়াতেই। পেশায় কিশোয়ার একজন ‘বিজনেস ডেভেলপার।’ কিশোয়ার দুই সন্তানের জননী। শিশুকন্যা সেরাফিনার বয়স চার বছর। আর ছেলে মিকাইলের বয়স ১২। কিশোয়ারের স্বামীর এহতেশাম নেওয়াজ।
গ্রান্ড ফিনাল যেমন ছিল
রিয়েলিটি শো মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার জমকালো গ্রান্ড ফিনাল দুই দিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন তিন ফাইনালিস্ট জাস্টিন, পিট ও কিশোয়ার। প্রথমদিন ফাইনাল ডিশে কিশোয়ার রান্না করেন ‘স্মোকড ওয়াটার রাইস’, ‘আলু ভর্তা’ ও ‘সার্ডিন’। অর্থাৎ বাঙালির কাছে চিরচেনা পান্তা-ভাত, আলু ভর্তা আর সার্ডিন মাছ ভাজি।
ফাইনাল ডিশ রান্না নিয়ে কিশোয়ার বিচারকদের জানান—প্রতিযোগিতায় এমন রান্না সত্যিই চ্যালেঞ্জের। সাধারণ রেস্টুরেন্টে এমন রান্না হয় না। কিন্তু বাঙালির কাছে এটা পরিচিত রান্না। আর ফাইনাল ডিশ হিসেবে এটা রেঁধে নিজের তৃপ্তির কথাও জানান কিশোয়ার।
তার এ রান্না দেখে ও খেয়ে বিচারকেরা রীতিমতো অভিভূত হয়ে পড়েন। ওই রাউন্ডি তিন বিচারক তাকে ১০/১০ দেন। তবে চূড়ান্ত পর্বের শুরুটা কিন্তু বেশ চ্যালেঞ্জের ছিল কিশোয়ারের জন্য। তিনি হাঁসের একটি পদ রান্না করা শুরু করেছিলেন। বিচারকেরা যখন তার রান্না দেখতে এলেন। সবকিছু দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন— ‘এখানে কিশোয়ার কোথায়?’ অর্থাৎ কিশোয়ারের বিশেষত্ব পাচ্ছিলেন না তারা।
এরপরেই তিনি তার মেন্যু চেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নেন। আর ফাইনাল ডিশ হিসেবে পরিবেশন করেন বাঙালির চির পরিচিত আলু ভর্তা, পান্তা ভাত আর সার্ডিন মাছ। যেই মাছের স্বাদ অনেকটা ইলিশ মাছের কাছাকাছি। চূড়ান্ত পর্বে ফাইনাল ডিশ রেঁধে ৫১ নম্বর নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন তিনি। প্রথম স্থানে ছিলেন পিট ৫৩ নম্বর নিয়ে।
ছেলের উৎসাহে মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় কিশোয়ার
২০২০ সালে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, তখন কিশোয়ারের মনে হয় সন্তানদের বাঙালি সংস্কৃতি কীভাবে ধারণ করাবেন। তখন চিন্তা করেন নিজের সংস্কৃতি নিয়ে বই লিখবেন তিনি। পরবর্তীতে ছেলের ইচ্ছায় তিনি মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার ১৩তম আসরে আবেদন করেন।
কিশোর জানিয়েছেন, তার ছেলের বয়স এখন ১২ বছর। এমন সময়ে বাচ্চাদের নিজ সংস্কৃতি, পূর্ব-পুরুষদের সম্পর্কে জানতে এবং তা ধারণ করাতে। তিনি ভাবতেন সন্তানদের জানাতে কী রেখে যাওয়া যায়?
তিনি গণমাধ্যমকে জানান, তার মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় আবেদন করার কোনো ইচ্ছেই ছিল না। কিন্তু তার সন্তান মিকাইল তাকে বলেন, ‘মা তুমি এটা (মাস্টারশেফ শোতে আবেদন) করো, তুমি অবশ্যই পারবে।’
‘তখন আমি ভেবেছিলাম আমার ছেলে মিকাইল বোধহয় জুনিয়র মাস্টারশেফে যেতে আগ্রহী। কারণ ও ভালো রান্না জানে। তাকে আবেদন করতে বললাম। তখন মাথায় আসলো- আমি আগে আবেদন করে তাদের জন্য একটা উদাহরণ তৈরি করতে পারি। সেই ভাবনা থেকেই আবেদন করি’ বলেন কিশোয়ার।
বাংলাদেশি না ভারতীয়—কী বলছেন কিশোয়ার?
কিশোয়ার বাংলাদেশি নাকি ভারতীয়—তা নিয়ে দুই দেশের মিডিয়া যখন দুই রকম তথ্য প্রকাশ করছেন। ঠিক তখন গণমাধ্যমে নিজের মনন নিয়ে ব্যাখ্যা দিলেন কিশোয়ার।
তিনি বলেন, ‘আমার বাবা বিক্রমপুরের, খাঁটি বাঙালি। মা বর্ধমানের। ফলে আমি বাংলাদেশি, তবে ইন্ডিয়ানও। তবে সবচেয়ে ভালো লাগে যদি বলি—আমি বাঙালি। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ—দুটো মিলেই আমার আইডেনটিটি (পরিচয়)। এটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
কিশোয়ার জানান, অস্ট্রেলিয়া, লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশে প্রচুর বাংলাদেশি ফুডের রেস্টুরেন্ট আছে। কিন্তু সেখানে বাঙালি খাবার খুব একটা দেখা যায় না। বেশিরভাগই হয় ভারতীয়। আমার ইচ্ছা ছিল—বাঙালি ফুড আইডেনটিটি তুলে ধরা। আর সেটাই আমি পূরণের চেষ্টা করেছি মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায়।’
মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া কতটা জনপ্রিয়?
বিশ্বের রান্নাবিষয়ক টেলিভিশন রিয়েলিটি শো-গুলোর মধ্যে মাস্টারশেফ অন্যতম। বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশ তাদের নিজস্ব মাস্টারশেফ আয়োজন করে থাকে। বিশ্বে মাস্টারশেফ অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে ‘মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া’জনপ্রিয়তার দিক থেকে রয়েছে তালিকার শীর্ষে। এটি প্রতিযোগিতামূলক রান্নার গেম শো।