পরিবর্তিত হচ্ছে জলবায়ু,বাড়ছে জনসংখ্যা ফলে দেশ থেকে ক্রমেই কমে যাচ্ছে আবাদি জমির পরিমাণ। আবাদি জমি কমে যাওয়ায় দেশ থেকে প্রত্যহ হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন।ভবিষ্যতে অধিক জনসংখ্যার খাবারের চাহিদা মেটানোর কথা চিন্তা করে বিজ্ঞানীরা খুঁজছে নতুন পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবারের।ভবিষ্যতের খাবার হতে হবে সুস্বাদু, সহজলভ্য ও পুষ্টিকর।এসব বিষয় বিবেচনায় গবেষকদের মনোযোগ 'স্পিরুলিনা' নামক একপ্রকার সামুদ্রিক শৈবালের দিকে।
এটি পুষ্টির দিক থেকে বিশ্বের সবথেকে দামি ও দুর্লভ খাদ্যপণ্যের একটি।স্পিরুলিনাতে উচ্চ প্রোটিন সহ প্রায় সকল পুষ্টির রয়েছে সুষম বণ্টন। এটি মিরাকল ফুড বা সুপার ফুড নামেও পরিচিত পুষ্টি বিজ্ঞানীদের কাছে। অধিক পরিমাণে পুষ্টিগুন থাকায় অনেকের কাছে আবার এটি গ্রিন ডায়মন্ড নামেও পরিচিত । দেশের মানুষের পুষ্টিচাহিদা মেটাতে স্পিরুলিনাতে অপার সম্ভবনা দেখছেন গবেষকরা।
স্পিরুলিনা নীলাভ সবুজ বর্ণের এককোষীয় সামুদ্রিক একধরনের শৈবাল। যার বৈজ্ঞানিক নাম Arthrospia maxiama। উচ্চমাত্রার পুষ্টিগুণের কারণেই এটি সুপার ফুড বা গ্রিন ডায়মন্ড নামে পরিচিত। পৃথিবী জুড়ে এই খাদ্যের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা।অপার সম্ভাবনাময় এই শৈবালটি ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে বাংলাদেশে চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়।পরবর্তীতে কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের তত্ত্বাবধানে স্পিরুলিনা চাষ শুরু হয়।তবে স্পিরুলিনা চাষ তখন টেকসই হয়নি।
পরবর্তীতে এই সামুদ্রিক শৈবাল স্পিরুলিনা চাষের ক্ষেত্রে বিশাল সম্ভাবনাময় পদ্ধতি উদ্ধাবনে সফল হন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের(শেকৃবি) একদল গবেষক। নতুন এই পদ্ধতিতে বাড়ির ছাদ বাগানে বা বারান্দায় খুব সহজেই উৎপাদন করা যাবে শতভাগ বিশুদ্ধ স্পিরুলিনা। ২০১৮ সালের শুরুর দিক থেকে পরিচালিত গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেকৃবি উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড.এ এফ এম জামাল উদ্দিন। এই পদ্ধতিতে মুখবন্ধ স্বচ্ছ বালতিতে স্পিরুলিনার চাষ করা হয়।ইতোমধ্যে এই পদ্ধতি বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
গবেষকদের মতে , ১০০ গ্রাম স্পিরুলিনায় ৩৭৪ কিলোক্যালরি শক্তি রয়েছে। ১০০ গ্রাম স্পিরুলিনার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই প্রোটিন। এ ছাড়া এতে উচ্চমাত্রায় লৌহ, পটাশিয়াম, জিংক ও ক্যালসিয়াম রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের হিসাবে, ১০০ গ্রাম স্পিরুলিনায় ৫৮২ গ্রাম কলিজার সমপরিমাণ লৌহ, তিনটি কলার সমপরিমাণ পটাশিয়াম, ৩৭৭ গ্রাম শাকের সমপরিমাণ জিংক ও ১১০ মিলিলিটার দুধের সমপরিমাণ ক্যালসিয়াম রয়েছে। ফলে বিভিন্ন দেশের পুষ্টিহীনতা দূর করতে জাতিসংঘ বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক প্রতিবেদনেও (২০০৮) স্পিরুলিনা ব্যবহারের সুপারিশ করেছে।
অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বার্তা২৪ কে জানান,‘দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ক্ষুদ্র ব্যাবসাহীদের নিয়ে কাজ চলছে এবং তারা ক্রমেই আগ্রহী হয়ে উঠছে স্পিরুলিনা চাষে।তাছাড়া বাজারে স্পিরুলিনা সমৃদ্ধ যে ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল পাওয়া যায় সেগুলোতে স্পিরুলিনার পরিমাণ খুবই কম থাকে।ফলে পুষ্টি উপাদান ও কম পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের এই মুখবন্ধ পদ্ধতিতে উৎপাদিত স্পিরুলিনা থেকে অধিক পরিমাণ পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়।তাই ক্রমেই মানুষের কাছে চাহিদা বাড়ছে পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ এই সামুদ্রিক শৈবালের।’
অধ্যাপক জামাল উদ্দিন স্পিরুলিনা চাষের সনাতন পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন,সনাতন পদ্ধতিতে কংক্রিটের পুকুরে স্পিরুলিনা চাষ করা হয়। তবে কংক্রিটের পুকুরে স্পিরুলিনা চাষ করা হলে পানিতে বাতাসের মাধ্যমে লতাপাতা, ধুলোবালি এমনকি কেঁচো ব্যাঙ ও মরা ইদুর পর্যন্ত মিশে যেতে পারে। আমরা যেহেতু স্পিরুলিনা সরাসরি খাই,তাই এই অবিশুদ্ধ স্পিরুলিনা খেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
তিনি স্পিরুলিনা চাষের আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন, আধুনিক পদ্ধতিতে মুখবন্ধ বালতিতে হাতের স্পর্শ ছাড়াই স্পিরুলিনা চাষ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে শুরুর দিকে খোলা কংক্রিটের পুকুরে স্পিরুলিনার চাষ শুরু হলেও বর্তমানে মুখবন্ধ বালতি পদ্ধতিই জনপ্রিয় হচ্ছে। স্পিরুলিনা খাওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে এই গবেষক বলেন সম্পূরক খাদ্য হিসেবে বিভিন্ন তরকারির সঙ্গে ব্যাবহার করা করা যায় এই শৈবাল।এক্ষেত্রে কয়েক গ্রাম স্পিরুলিনা ব্যাবহারই যথেষ্ট। আর এই শৈবালটিতে কোনো গন্ধ নেই বলে এটি চা,কফি,নুডলস,আইসক্রিমের সঙ্গে খুব সহজেই ব্যবহার করা যায়।
শেকৃবির কৃষি অনুষদ ভবনের ছাদে ঢুকে একটু এগোলেই এখনো চোখে পড়বে বহুসংখ্যাক সাদা ড্রাম। পাইপের মাধ্যমে এগুলোর একটির সাথে অন্যটি সংযুক্ত। ড্রামের ভেতরের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে নানা উপাদান মিশ্রিত পানির দ্রবণ। যেখানে সমুদ্রের পানির মত ড্রামের ভেতরের পানি চলমান রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ব্লোয়ার মেশিন। আর এর মধ্যেই উৎপাদিত হচ্ছে স্পিরুলনা। গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড.আ ফ ম জামাল উদ্দিন বলেন, আমরা চার ফুট উচ্চতা ও তিন ফুট ব্যাসসম্পন্ন ৯৬টি ফুডগ্রেডেড ড্রাম ব্যবহার করেছি। প্রতিটি ড্রামে ২৫০ লিটার পানিতে সোডিয়াম বাইকার্বোনেট, ইউরিয়া, মিউরেট অব পটাশ (এমওপি), ম্যাগনেসিয়াম সালফেট নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে দ্রবণ প্রস্তুত করেছি। এই দ্রবণ থেকে স্পিরুলিনা প্রয়োজনীয় সব খাদ্য নিতে পারবে। একবার তৈরীকৃত দ্রবণের মাধ্যমে প্রায় ৬ মাস পর্যন্ত স্পিরুলিনা উৎপাদন করা সম্ভব। তবে ৬ মাস পর পুনরায়।
অসংখ্য পুষ্টি উপাদানে ভরপুর স্পিরুলিনার উপকারিতা সম্পর্কে এই গবেষক বলেন,ডায়েবিটিস, বার্ধক্যজনিত রোগ,রক্তশূন্যতা প্রতিবন্ধীও গর্ভবতী মায়েদের জন্য স্পিরুলিনা খুবই কার্যকরি।এটি ক্যান্সার প্রতিরোধে সক্ষম। এছাড়াও স্পিরুলিনা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে,মস্তিষ্কের শক্তি বাড়ায়, হজম ক্ষমতা বাড়ায় ও রক্তের শর্করা কমাতে সাহায্য করে।