ল্যাকটোজ একটি ডাইস্যাকারাইড, অর্থাৎ এটি দুটি সরল শর্করা (গ্লুকোজ ও গ্যালাকটোজ) দিয়ে গঠিত। গ্লুকোজ আমাদের দেহে শক্তি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন। গ্যালাকটোজের রাসায়নিক গঠন গ্লুকোজের মতই, শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে এটা গ্লুকোজেও পরিবর্তিত হতে পারে।
এছাড়াও এটি কোষ ঝিল্লির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রকৃতিতে স্তন্যপায়ীদের দুধ ছাড়া অন্য কোথাও ল্যাকটোজ বিরল।শিশুরা এই গুরুত্বপূর্ণ শক্তির উৎসকে জীবনের প্রথম বছরে ব্যবহার করে (Silanikove et al, 2015)। শিশুদদের পরিপাকতন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়া (প্রোবায়োটিক) উৎপাদনে সহায়তা করে যা শিশুদের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে (Fassio et al., 2018)।
দুধ ও অন্যান্য দুগ্ধজাত খাবারের ল্যাকটোজ নামক ভাঙ্গতে ল্যাকটেজ নামক এনজাইমের প্রয়োজন। অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণীতে এই এনজাইমের উৎপাদন বন্ধ হয়, যখন তারা দুধ খাওয়া ছেড়ে দেয়। তবে পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ মানুষ এই এনজাইমের উৎপাদন প্রায় সারাজীবনই করে থাকে।
যদি যথেষ্ট পরিমাণ ল্যাকটেজ উৎপন্ন না হয়,তবে ল্যাকটোজ থাকে এমন খাদ্য গ্রহণের ফলে পরিপাক সংক্রান্ত জটিলতা যেমন- পেট ব্যাথা, ডায়রিয়াতে ভোগে। এই অবস্থাকে ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স বলা হয়ে থাকে। অনেকে একে ল্যাকটোজ ডেফিসেন্সিও বলে।
ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে-
• প্রাইমারি ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স:
যখন শিশু অবস্থায় থাকে তখন দুধ হজমের জন্য যথেষ্ট ল্যাকটেজ এনজাইম থাকে। আস্তে আস্তে শিশুরা যখন পারিবারিকক খাবারের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে থাকে তখন এনজাইমের উৎপাদন হ্রাস পেতে আরম্ভ করে এবং দুধ হজমে সমস্যা আরম্ভ হয়।
• সেকেন্ডারি ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স:
যদি ক্ষুদ্রান্ত্রে কোন অপারেশন বা সার্জারির কারণে ল্যাকটোজ উৎপাদন হ্রাস পায় তবে তা এই ধারণের অন্তর্ভূক্ত হবে সাধারণত সিলিয়াক ডিজিস, intestinal Infection, Crohn's disease এর কারণে ক্ষুদ্রান্ত্রে এনজাইম উৎপাদন হ্রাস পায়।
• জন্মগত ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স:
এটা সম্ভব কিন্তু বিরল। এই ডিসর্ডার বংশগত। মা ও বাবার থেকে একটি করে মিউটেটেড জিন যখন সন্তানের মধ্যে আসে তখন এই সমস্যা সৃষ্টি হয়। এছাড়াও পূর্বেই জাত (premature) শিশুদের ল্যাকটেজ উৎপাদন ক্ষমতা কম থাকলে এই এই সমস্যা সৃষ্টি হয়।
ককেশীয় অঞ্চলে বসবাসকারীদের ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স হওয়ার সম্ভবনা অনেক কম কিন্তু এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কিছু দেশে পাঁচ বছর বয়স অতিক্রম করার পর ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সের সম্ভবনা অনেক বেশি। বিশ্বের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষের ল্যাকটোজ প্রোডাকশন ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে, বিশেষ করে তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সে ল্যাকটেজ হ্রাসের মাত্রা দুগ্ধপোষ্য অবস্থার চেয়ে ১০% কমে যায়। (Ugidos-Rodriguez et al, 2018).
পরিণত বয়সে বিশ্বের মাত্র এক চতুর্থাংশ মানুষের ল্যাকটোজ হজম করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ল্যাকটেজ এনজাইম থাকে। (Szilagyi & Ishayek, 2018)
দক্ষিণ এশীয় প্রাপ্তবয়স্কদের ৯৫% এর ল্যাকটেজ স্বল্পতা, অন্যদিকে স্ক্যান্ডিনিভিয়ান অঞ্চলের মাত্র ১০% প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ ল্যাকটেজ এনজাইম স্বল্পতায় ভোগে। (Forsgård, 2019)
ল্যাকটটেজ এনজাইম ক্ষুদ্রান্ত্রের পাওয়া যায়। ক্ষুদ্রান্ত্রে ল্যাকটেজ এনজাইম ল্যাকটোজকে ভেঙ্গে গ্লুকোজ ও গ্যালাকটোজ নামক সরল শর্করায় রূপান্তরিত করে।
যখন প্রয়োজনীয় এনজাইম উৎপন্ন হয় না তখন তা ক্ষুদ্রান্ত্রে ল্যাকটোজ সম্পূর্ণ না ভেঙ্গে বৃহদান্ত্রে যায়।
বৃহদান্ত্রে অনেক ব্যাকটেরিয়া থাকে, যেগুলো অহজমকৃত ল্যাকটোজের সঙ্গে ফার্মেন্টেশন বিক্রিয়া করে ল্যাকটেট,ফ্যাটি এসিড ও বিভিন্ন গ্যাস (হাইড্রোজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন) উৎপন্ন করে। যার ফলে পেট ফেপে যায়, ব্যাথা হয়।
ল্যাকটোজ জাতীয় খাদ্য গ্রহণের ত্রিশ মিনিট থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে এইসব লক্ষণ দেখা যায়। (Costanzo & Canani, 2018)
অনেক মানুষের ল্যাকটেজ স্বল্পতা থাকলেও নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত ল্যাকটোজ সহ্য করতে পারে। যদি কেউ ল্যাকটেজ স্বল্পতায় ভোগে তবে সে যদি ১২ গ্রামের কম ল্যাকটোজ গ্রহণ করে তবে তার ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সম্ভবনা কম থাকে। (Dekker et al, 2019) যেসব খাবারে ল্যাকটোজের মাত্রা বেশি সেগুলো কম, আবার যেসব খাবারে ল্যাকটোজের মাত্রা কম সেসব একটু বেশি খাওয়া যেতে পারে,তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন ল্যাকটোজ ১২ গ্রাম অতিক্রম না করে।
Low fat Milk অপেক্ষা উচ্চ ফ্যাটযুক্ত দুধ ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সের ক্ষেত্রে ভালো।কারণ ফ্যাটের সঙ্গে ল্যাকটোজ গ্রহণ করা হলে ল্যাকটোজ পাকস্থলী থেকে আস্তে আস্তে ক্ষুদান্ত্রে যায়।ফলে অল্প ল্যাকটেজ দিয়ে হজমে তত বেশি বেগ পেতে হয় না, যার ফলে লক্ষণ কম প্রকাশ পায়, যদিও দুধে ফ্যাটের পরিমাণ মাত্র ৪-৫%। (Ugidos-Rodriguez et al, 2018)
কিছু তরল দুধ ও দধি(yogurt) উৎপাদনের সময় এগুলোতে ল্যাকটেজ এনজাইম যুক্ত করে দেওয়া হয়, ফলে এসব খাদ্য খাদকের মুখে যাওয়ার আগেই ল্যাকটোজকে ভেঙ্গে ফেলে।যদিও এর ফলে খাবারের স্বাদের পরিবর্তন হয়,কিন্তু কোন সমস্যা দেখা দেয় না।
দই,দধি সহ ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন দুগ্ধজাতীয় খাবারে যেসব উপকারী ব্যাকটেরিয়া রয়েছে সেগুলো ল্যাকটেজ এনজাইম উৎপন্ন করে। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ল্যাকটেজ স্বল্পতায় ভোগা মানুষেরা তরল দুধের ১৮গ্রাম ল্যাকটোজ গ্রহণ করার ফলে যেসব লক্ষণ দেখা দিয়েছে, ঠিক সম পরিমাণ দধির ল্যাকটোজ গ্রহণের ফলে একই বৈশিষ্ট সম্পন্ন ব্যক্তিদের তার চেয়ে কম লক্ষণ দেখা দিয়েছে। দেখা যায় যে দধির ল্যাককটোজের ৯০% ই ক্ষুদ্রান্ত্রে হজম হয়েছে। (Savaiano, 2014)
দুধ থেকে পনির তৈরির সময় অনেকদিন রেখে দেওয়া হয় যাতে ব্যাকটেরিয়ার সহায়তায় আকাঙ্ক্ষিত গন্ধ ও গঠন পাওয়া যায়। ফলে এতে থাকা ল্যাকটোজ, ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা ভেঙ্গে যায়। এ কারণে পনিরে খুবই অল্প পরিমাণ ল্যাকটোজ থাকে।
অনেকে ল্যাকটেজ এর অভাব পূরণের জন্য ল্যাকটেজ এনজাইম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করে থাকেন। এটাও কার্যকরী তবে এক্ষেত্রে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের সময়ের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ল্যাকটোজ জাতীয় কিছু গ্রহণের পাঁচ থেকে ত্রিশ মিনিট পূর্বে এই সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে। (Fassio et al, 2018)
লেখক: প্রবল কুমার মন্ডল, পুষ্টিবিদ ও লেখক
Email: probal.official@outlook.com
01827664306