নিজের হাতঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন রুমি। প্রায় আধা ঘন্টা একই স্থানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন বাসের অপেক্ষায়। এতোটা সময় পেরিয়ে গেলেও, গন্তব্যের কোন বাসের দেখা পাওয়া যায়নি এখনও। এদিকে রয়েছে অফিসে পৌঁছানোর তাড়া। উপরি হিসেবে আরো আছে রাস্তার সিগন্যালগুলোতে দীর্ঘ যানজট।
নানান দুশ্চিন্তার মাঝে স্বস্তি আনতে রাস্তার শেষ মাথায় দেখা দিলো রুমির কাঙ্ক্ষিত বাস। বাস স্টপেজের কাছে বাস এসে থামতেই, মুহূর্তে লোকজনের ভিড় তৈরি হয়ে গেলো বাসের দরজার কাছে। লোকজনের ভিড় ঠেলে দরজার কাছে পৌঁছানো মাত্র বাসের কন্ডাকটর সশব্দে বলে উঠলেন, ‘মহিলা যাত্রী নিমু না, বাস ফিলাপ।’ রুমি প্রতিবাদ করে বললেন, ‘অন্যরা তো বাসে উঠছেন, সমস্যা কোথায়।’ কন্ডাক্টর রুমির প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না।
রুমি আবারো বলার চেষ্টা করলেন, ‘আমি দাঁড়িয়েই যাব।’ এবারও কন্ডাক্টর তার কথায় কোন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। অন্য সকলে বাসে উঠে গেলেও রুমি রয়ে গেলেন পেছনে। বিরক্ত ও ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেন রুমি। ওদিকে হাতঘড়িটা জানাচ্ছে যে, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই।
রুমির মতো এমন অসংখ্য ভুক্তভোগী নারী যাত্রী রয়েছে পুরো ঢাকা শহর জুড়ে। প্রতিদিন এমন অগণ্য সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ঢাকার সকল বয়সী নারীদের।
বার্তা২৪.কমের করেস্পন্ডেন্ট কথা বলেছিলেন বসুন্ধরা আবাসিকগামী একজন নারী যাত্রীর সাথে। ফার্মগেটে অপেক্ষারত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই যাত্রী জানান, প্রায় প্রতিদিন বাসের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। এরপর কাঙ্ক্ষিত বাস আসলেও বাসে ওঠা সম্ভব হয় না। কারণ সংরক্ষিত নারী আসন খালি না থাকলে অথবা বাসে বেশী ভিড় থাকলে, বাস কন্ডাক্টর নারী যাত্রী নিতে অস্বীকৃতি জানায়। জানালেন, বাধ্য হয়ে অনেক সময় জোর করেই বাসে উঠে যান তিনি।
বাস না পাওয়া ও বাসে উঠতে না পারার বিড়ম্বনা নিয়ে কথা বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সংবাদকর্মী। বার্তা২৪.কমকে তিনি জানান, নিজের অন্তঃসত্ত্বাকালীন একদিনের চরম দুর্ভোগের ঘটনা।
সালটা ছিল ২০১৬। অফিস শেষে বিকেলবেলা কারওয়ান বাজার মোড়ে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। দেখতে দেখতে প্রায় ঘন্টাখানেক পার হয়ে গেলেও কোন বাসে উঠতে পারেননি তিনি। দুর্ভাগ্যবশত, তার গন্তব্যে কোন সিএনজিও যেতে রাজি হয়নি সেদিন। পরবর্তীতে বহু কষ্টে বাসাতে পৌঁছান তিনি।
দুই বছর পার হয়ে গেলেও এমন দুর্ভোগের চিত্র কিন্তু খুব একটা কমেনি বা বদলায়নি। এখনও বাসের জন্য দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা, বাসের গেটলক, বাসে উঠতে না পারা ও বাসে উঠতে না দেওয়ার মতো সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছেন নারী যাত্রীরা প্রতিদিন।
তবে এই সকল সমস্যার মাঝে কিছু প্রশান্তি নিয়ে এসেছে উবার, পাঠাও, ওভাই/ ওবোন এর মতো রাইড শেয়ারিং অ্যাপসগুলো। ইতিমধ্যেই দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই রাইড শেয়ারিং অ্যাপসগুলো। যাত্রীদের মাঝে তৈরি করেছে ইতিবাচক প্রভাব। তবে নিত্যদিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশ ব্যয়বহুল হয়ে যায় বলে ঘুরেফিরে বাসের উপরেই নির্ভর করতে হয় সকলকে।
বাস সংকট তার চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে বৃষ্টি-বাদলের দিনে ও রমজান মাসে। ঘণ্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় বাসের অপেক্ষায়। কাঙ্ক্ষিত বাস পাওয়া গেলেও বাসে উঠতে হয় যুদ্ধ করে। তাইতো প্রতিদিনের রুটিনটা বেশীরভাগ নারীর জন্যেই কমবেশী একই রকম হয়ে দাঁড়ায়।
সময় বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে জীবনযাপনের ধরণ। সেক্ষেত্রে গণপরিবহনে চলাচলের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে খুব দ্রুত- এমন চাওয়া সকলের। সামনে এমন একদিন নিশ্চয় আসবে, যেদিন কোন নারী যাত্রীকে বাসে ওঠার জন্য যুদ্ধ কিংবা তর্ক- কোনটাই করতে হবে না। তবে পরিবর্তনের আশায় থেমে নেই কেউ। এই সকল সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাকে সাথে নিয়েই ছুটে চলছে প্রতিটি নারী। তারা জানেন, থেমে থাকলে এগোন সম্ভব নয়।