বর্তমানে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাস নামের এক ধরনের রোগ। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাসের জীবাণু। আমাদের বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অনুযায়ী বাংলাদেশে এই রোগ সর্বমোট আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ১৩ হাজার এরও বেশি। কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যারা প্রাইমারি অবস্থায় থাকে তারা চিকিৎসকের পরামর্শ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে দ্রুত সুস্থ হতে পারে কিন্তু এমন কিছু গুরুতর আক্রান্ত রোগী আছে যাদের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (ICU) এ রেখে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। কোভিড-১৯ ভাইরাস সাধারণত শ্বাসনালীতে এবং ফুসফুসের কোষগুলোতে আক্রমণ করে।
দিনের পর দিন যুদ্ধ করে যেসব আক্রান্ত রোগী ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (ICU) এ থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠে সেসব রোগীদের পরবর্তী যে সমস্যাগুলো দেখা যায় এবং এই সমস্যা সমাধানের জন্য কারা কাজ করে থাকেন তাদের নিয়ে আলোচনা করব।
ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (ICU), যেখানে খুবই গুরুতর রোগীদের প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করা হয় এবং রোগীর ফুসফুস যদি কাজ না করে সে ক্ষেত্রে রোগীর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের কাজটা ভেন্টিলেটর করে থাকে, যার মাধ্যমে রোগী সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়তে এবং পুরোপুরিভাবে সেরে উঠতে কিছুটা সময় পান। যেহেতু কোভিড- ১৯ আক্রান্ত রোগীদের শ্বাসনালীতে ও ফুসফুসে সমস্যা থাকে তাদের জন্য ভেন্টিলেটর একটি আদর্শযন্ত্র।
ভেন্টিলেটর কি?
ভেন্টিলেটর হল ‘লাইফ সেভিং ডিভাইস। একে বলা হয় সাপোর্টিভ চিকিৎসা। অনেক সময় রোগ জটিলতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছলে দেখা যায় রোগী নিজে থেকে শ্বাস নিতে পারছেন না। তাঁর শ্বাসযন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করছে। রেসপিরেটরি ফেলিওর হচ্ছে। তখন কৃত্রিম উপায়ে বাইরে থেকে মেশিনের সাহায্যে শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রাখার চেষ্টা করা হয়। এটাই ভেন্টিলেশন।
ভেন্টিলেটর দুই প্রকার– মেকানিক্যাল ও নন ইনভেসিভ ভেন্টিলেটর- মেকানিক্যাল ভেন্টিলেটর, নন ইনভেসিভ ভেন্টিলেটর।
একজন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী যখন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (ICU) এ থাকে, তাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। ভেন্টিলেটর সাধারণত মুখ থেকে গলা হয়ে ভোকাল কর্ড এর মধ্য দিয়ে ট্রাকিয়ায় পৌঁছায়। দীর্ঘদিন ভেন্টিলেশন এ থাকা অবস্থায় আক্রান্ত রোগীর গলার মাংশপেশি দুর্বল হয়ে যায়।
এখন আমরা জানাবো দীর্ঘদিন ভেন্টিলেশন ও ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (ICU) থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে আসার পর কোভিড-১৯ রোগীদের পরবর্তী কি কি সমস্যা হতে পারে-
যোগাযোগের সমস্যা: দীর্ঘদিন রোগীকে যখন মেকানিকেল ভেন্টিলেশন অবস্থায় রাখা হয় তখন ভেন্টিলেটর যন্ত্রটি সেই রোগী যোগাযোগের অনেক বাধা দেয়। যার ফলে রোগী তার প্রয়োজনীয় চাহিদা প্রকাশ করতে পারে না। এরপর দেখা যায় রোগী সুস্থ হয়ে আসার পর তার যোগায়োগের সমস্যা হয়।
যেমন: কথায় জড়তা চলে আসা, দীর্ঘক্ষণ কথা বলার সময় হাঁপিয়ে উঠা বা ক্লান্ত অনুভব করা। এছাড়াও তাদের কগনিটিভ সমস্যা দেখা দেয় যার ফলে কথা বুঝতে, কথা বুঝিয়ে ও গুছিয়ে বলতে পারে না, এমনকি কথা ভুলেও যায়।
খাবার গলাধঃকরণে সমস্যা: রোগীর খাবার গলাধঃকরণের সমস্যাও হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন ভেন্টিলেশন এ থাকায় তাদের ল্যারেনজিয়াল মাসেল বা মাংসপেশি অনেক দুর্বল হয়ে যায়। এই দুর্বলতার কারণে তাদের খাবার গিলতে ও চাবাতে সমস্যা হয়। এছাড়াও খাবার (শক্ত ও তরল), পানি খাওয়ার সময় খাবারটা খাদ্যনালিতে না গিয়ে সরাসরি শ্বাসনালিতে চলে যায়। এর ফলে খাবার ও পানি খেতে গেলে কাশি আসে।
কণ্ঠস্বর জনিত সমস্যা: মানুষের গলার সামনের অংশে ল্যারিংস বা শব্দযন্ত্র থাকে। এতে আছে দুটি ভোকাল কর্ড ভোকাল কর্ড দেখতে (V) আকৃতির। কর্ড দুটি কম্পনের মাধ্যমে শব্দ তৈরিতে ও আমাদের কথা বলতে সাহায্য করে। দীর্ঘদিন ভেন্টিলেশন এ থাকা অবস্থায় রোগীর ভোকাল কর্ড ঠিকমত কাজ করে না ফলে উল্লেখিত সমস্যা হয় যেমন: ভোকাল ফোল্ড পালসি, কর্কশ ও ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠস্বর।
উপরোক্ত সমস্যাগুলো নিয়ে যারা কাজ করে থাকেন-
দীর্ঘদিন ভেন্টিলেশন ও ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (ICU) থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে আসার পর কোভিড-১৯ রোগীদের পরবর্তী সমস্যাগুলো (যোগাযোগের, খাবার গলাধঃকরণের সমস্যা ও কণ্ঠস্বর জনিত সমস্যা) নিয়ে কাজ করে থাকেন একজন স্পিচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাথিস্ট।
স্পিচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাথি একটি বিশেষায়িত চিকিৎসা ব্যবস্থা। একজন স্পিচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট এভিডেন্স বেসড চিকিৎসার মাধ্যমে কোভিড-১৯ রোগীর পরবর্তী জটিল সমস্যাগুলো (যোগাযোগ সমস্যা, খাবার গলাধঃকরণ জনিত সমস্যা ও কণ্ঠস্বর জনিত সমস্যা) সমাধান করে থাকেন। তাই বলা যেতে পারে কোভিড- ১৯ রোগী সুস্থ হয়ে আসার পর যে সমস্যাগুলো হয় তা সমাধানে একজন স্পিচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট এর ভূমিকা অপরিসীম।
এরূপ সমস্যা সমাধানে অবশ্যই আপনারা একজন দক্ষ স্পিচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্টের কাছে শরণাপন্ন হবেন।
লেখক: মো. হাসিবুল হাসান, স্পিচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট, সিআরপি।