নতুন বছর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো বছরকে দিতে হবে বিদায়। তবে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় ঠাসা বছরের বহু স্মৃতি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ২০১৯ সালে রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাপক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে তা বিগত যে কোন বছরের তুলনায় বেশি। দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে ২২ হাজার অগ্নি দুর্ঘটনায় ক্ষতি হয়েছে ২০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ। নিহত হয়েছেন ১৮৭ জন। বছরজুড়ে আগুনে পোড়া ক্ষতে কেঁদেছে গোটা দেশ।
অগ্নিনির্বাপণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফায়ার সার্ভিস অবশ্য বলছে, সচেতনতার অভাব এবং ত্রুটিপূর্ণ ভবন ব্যবস্থার কারণে অগ্নিকাণ্ড বেড়ে গেছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে প্রায় ২২ হাজার ৩৫২টি, যা ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এ সময় নিহত হয়েছে ১৮৭ জন, আর আহত ৩৯১ জন। আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২০৫ কোটি টাকার।
চলতি বছরে ঘটে যাওয়া রাজধানিতে অগ্নিকাণ্ডের মাঝে উল্লেখ্যযোগ্য ছিল বনানীর বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার আগুন, ঢাকার কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানায় আগুন। ভয়ানক এসব আগুনে পুড়ে বহু প্রাণ ঝরে গেছে।
কেরানীগঞ্জে প্লাস্টিক কারখানায় আগুন
চলতি মাসেই ঢাকার কেরানীগঞ্জে প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরির কারখানায় আগুন লাগার ঘটনায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন দগ্ধ ১৯ জন (১৭ ডিসেম্বর)।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দগ্ধ আরো ১৫ জনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। এ ঘটনায় কারখানাটিতে প্রায় ১ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়।
পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় আগুন
চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে। ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি স্টেশনের ৩৭টি ইউনিট টানা ৫ ঘণ্টারও বেশি সময় চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয় ৭১ জন, আর আহত হয় ১০৫ জন।
এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ফের আলোচনায় আসে পুরনো ঢাকার রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানা। এর আগে নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক প্রাণহানি হওয়ার পর রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানাগুলো সরানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ফলে ফের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর সবার টনক নড়ে। বেশ কয়েকদিন আলোচনায় থাকে পুরান ঢাকার এ দুর্ঘটনা।
বনানীর ফারুক-রূপায়ন টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড
রাজধানীর বনানীর বহুতল ভবন এফআর (ফারুক রূপায়ন) টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড ঘটে গত ২৮ মার্চ। ২২ তলা ভবনের অষ্টম তলা থেকে বেলা ১টায় আগুনের সূত্রপাত হয়, যা পরে অন্যান্য তলায়ও ছড়িয়ে পাড়ে। ভবন থেকে নিচে পড়ে মারা যান কয়েকজন। এ ঘটনায় মোট ২৬ জনের মৃত্যু হয় এবং আহত হয় ৭০ জন।
এদিকে ফায়ার সার্ভিসের গত কয়েক বছরের হিসাব মতে, ২০০৮ সালে ৯ হাজার ৩১০টি অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ২২৯ জন, আহত হন ১ হাজার ৩৫৬ জন। এরপর ২০০৯ সালে ১২ হাজার ১৮২টি অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ১১৮ জন। ২০১০ সালে ১৪ হাজার ৬৮২টি অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ৬৩ জন।
এছাড়া ২০১১ সালে ১৫ হাজার ৮১৫টি অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ৩৬৫ জন। পরের বছর ১৭ হাজার ৫০৪টি অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ২১০ জন। ২০১৩ সালে অগ্নি দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৯১২তে। নিহত হন ১৬১ জন। পরের বছর ১৭ হাজার ৮৩০টি অগ্নি দুর্ঘটনায় ৭০ জন প্রাণ হারান। ২০১৫ সালে ১৭ হাজার ৪৮৮টি অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৬৮ জন। তার পরের বছর ১৬ হাজার ৮৫৮টি অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৫২ জন। ২০১৭ সালে ১৮ হাজার ১০৫টি অগ্নি দুর্ঘটনায় মারা যান ৪৫ জন। পরের বছর সর্বোচ্চ ১৯ হাজার ৬৪২টি অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১৩০ জন। ২০১৯ সালে বিগত বছরের সকল হিসেবে ছাড়িয়ে গেছে।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের অর্ধেক পর্যন্ত ২২ হাজার ৩৫২টি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছে। যা বিগত সালের আগুনের ঘটনার থেকে অনেক বেশি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন বার্তা২৪.কমকে বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশে দ্রুত উন্নয়ন ঘটছে। ছোট বড় বহুতল স্থাপনা, কারখানা ও ভবন নির্মাণও বাড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অগ্নি দুর্ঘটনাও বাড়ছে। যে কোন প্রকার অগ্নি দুর্ঘটনায় কাজ করতে ফায়ার সার্ভিস প্রস্তুত আছে।
ফায়ারের এই ডিজি বলেন, এখন আমাদের মূল কাজ হবে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে নাগরিকদের মাঝে অধিক পরিমাণে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। অন্যথায় অগ্নি দুর্ঘটনা কোনক্রমেই রোধ করা সম্ভব হবে না।