এই দিনে: ১৩ মে
নাট্যকার, সংগঠক, পরিচালক বাদল সরকারের মৃত্যু
সত্তরের দশকের উত্তাল সময়ের শুরু থেকে ‘থার্ড থিয়েটার’ নামক ভিন্ন এক নাট্যআঙ্গিক ও দর্শনের উদ্গাতা ছিলেন বাদল সরকার। বাংলা নাটকের জগতে ‘থার্ড থিয়েটার’ নামে নতুন এক আঙ্গিকের সূচনা করে অমর হয়ে আছেন তিনি।
১৯২৫ সালের ১৫ জুলাই কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন বাদল সরকার। তাঁর প্রকৃত নাম- সুধীন্দ্র সরকার। স্কুল ও কলেজ জীবনে তাঁর এই নামই বহাল ছিল। পরবর্তীতে পরিচিত হয়েছিলেন বাদল সরকার নামে।
স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে ভর্তি হন বাদল সরকার। পেশাগত দিক থেকে তিনি ছিলেন টাউন প্ল্যানার। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করার পর প্রথমে মাইথন, পরে কোলকাতায় চাকরি করেন।
তাঁর জীবন কাহিনি সম্পর্কে এক ব্লগে নূর মোহাম্মদ নুরু লেখেন- শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বাদল সরকারের অন্যতম সহপাঠী ছিলেন সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর টাউন প্ল্যানার হিসেবে কাজ করেছেন ভারতে ও বিভিন্ন দেশে।
ইংল্যান্ড ও নাইজেরিয়াতে পেশার কাজে যান। আবার সাহিত্য-নাটকের প্রতি আগ্রহের জন্য বৃদ্ধ বয়সে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পারেটিভ লিটারেচার ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন।
১৯৯২ সালে সেখান থেকে এ বিষয়ে এমএ পাস করেন তিনি। ১৯৫৬ সালে বাদল সরকার প্রথম নাটক ‘সলিউশন এক্স’ লেখেন। তবে এটি মৌলিক ছিল না। নাটকটি লেখা হয়েছিল ‘মাঙ্কি বিজনেস’ সিনেমা অবলম্বনে।
সর্বভারতীয় খ্যাতি যে নাটকের মাধ্যমে
তার পরে বাদলবাবু আরো কয়েকটি মৌলিক নাটক লিখলেও তাঁকে সর্বভারতীয় খ্যাতি এনে দেয়, ষাটের দশকের মাঝামাঝি ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ নাটকটি। এই নাটকটি ‘বহুরূপী’ পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর তাঁর রচিত ‘বাকী ইতিহাস’ ‘প্রলাপ’, ‘পাগলা ঘোড়া’ ‘শেষ নাই’ সবকটিই শম্ভু মিত্রের নেতৃত্বাধীন বহুরূপী গোষ্ঠীর প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হয়। তবে নিজের নাট্যদল ‘শতাব্দী’ গঠনের পর তিনি একেবারে কলকাতার কার্জন পার্কে খোলা আকাশের নিচে নাটক করা শুরু করেন।
থার্ড থিয়েটারের আঙ্গিক, তার প্রয়োজনীয়তা, পাশ্চাত্যে প্রবর্তিত থার্ড থিয়েটারকে বাদল সরকার বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে জনপ্রিয় করেছেন। আসলে বাদল সরকারের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় থার্ড থিয়েটারের উৎপত্তি সামন্ত সমাজের সেই গুটিকয়েক শিক্ষিতের দ্বারা, যারা ভূস্বামী বা কৃষক কোনো শ্রেণির মধ্যে পড়ে না।
অনেক সময় তাঁর নাটকে কোনো প্লট থাকে না। চরিত্রের সুনির্দিষ্ট কোনো চরিত্রায়ন নেই। ফলে বাধ্যবাধতকতা নেই সুনিদিষ্ট পোশাকেরও। অভিনেতা–অভিনেত্রীরা ইচ্ছেমতোন চরিত্র বাছাই করে নেন। নাটকের মাঝখানে চরিত্র বদলেরও স্বাধীনতা থাকে। প্রয়োজন বুঝলে দর্শকেরাও অভিনয়ে অংশগ্রহণ করতে পারেন। ঠিক অংশগ্রহণ সেভাবে আক্ষরিক অর্থে নয়, খুব জোরালোভাবে কিন্তু দর্শক ঢুকে পড়েন কিছু একটা করতে, যা অনেকটা সিনেমার ‘এক্সট্রা’দের মতো।
বাদল সরকারের থার্ড থিয়েটার আন্দোলন ছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধী তথা রাষ্ট্রবিরোধী। শহরাঞ্চলকে ভিত্তি করে তাঁর ‘ভোমা’ নাটকে পাওয়া যায় নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন সংগ্রামের প্রতিফলন। আবার ‘মিছিল’ নাটকে উঠে আসে ক্ষুব্ধ মানুষের প্রতিবাদ আর তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে রাষ্ট্রের ভূমিকা ৷
১৯৫৭-৫৯ লন্ডনে ও ৬৩-৬৪ সালে ফ্রান্সে থাকার সময় প্রচুর ইউরোপীয় থিয়েটার দেখার সুযোগ পান। এরপর নাইজেরিয়ায় কর্মসূত্রে থাকার সময় অনেকগুলো নাটক লেখেন। ১৯৬৭ সাল থেকে টাউন প্ল্যানিংয়ের চাকরি নিয়ে কলকাতায় স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন। বেশি বয়সে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করে এমএ ডিগ্রিও সম্পন্ন করেন।
সরস ও ব্যঙ্গাত্মক রচনার মধ্য দিয়ে তাঁর নাটক রচনার শুরু। ‘বড় পিসিমা’, ‘রাম শ্যাম যদু’, ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ প্রভৃতি তাঁর কৌতুক নাটকগুলির মধ্যে অন্যতম। নাটকগুলি ‘রঙ্গনাট্য সংকলন’ নামক গ্রন্থে সংকলিত হয়। কৌতুক নাটক ছেড়ে তিনি সমসাময়িক পরিস্থিতি ও জীবনদর্শনের ওপর ভিত্তি করে নাটক রচনা শুরু করেন। নাটক লেখা, প্রযোজনার কাজ ছাড়াও দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ানোতে অদম্য উৎসাহ ছিল তাঁর। বিশ্বভাষা ‘এস্পারেন্তো’ নিয়ে ছিল তাঁর বিশেষ আগ্রহ। এ নিয়ে কয়েকটি বইও লিখেছেন তিনি। শেষ কয়েক বছরে আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘পুরানো কাসুন্দী’-তে বিস্তারিতভাবে নাটক দেখা, করা, নাটক নিয়ে নানা ভাবনা চিন্তার কথা সরসভাবে লিখে গেছেন বাদল সরকার।
এই নাট্যকারের জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ (১৯৬৩) এই ঘরানার নাটকের অন্তর্ভুক্ত। চিন-ভারত যুদ্ধ এবং কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এই নাটকের মৌলিক বিষয়। ‘সারারাত্তির’, ‘বাকি ইতিহাস’, ‘প্রলাপ’, পাগলা ঘোড়া’ প্রভৃতি নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি সমকালীন চিত্রকে নিখুঁত দক্ষতায় প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন।
বাদল সরকারের নাটকের মধ্যে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের রূপরেখাটিও বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। নকশালবাড়ি আন্দোলনের ঝড়, সত্তরের দশককে মুক্তির দশক করে তোলার স্বপ্ন, শ্রমিক-মালিক শ্রেণির অনিবার্য সংঘাত প্রভৃতি তাঁর নাটকের অন্তর্গত বিষয়।
তিনি নিজে মন্তব্য করেন, ‘হাসবার ক্ষমতা চলে যাচ্ছে আমার। আজগুবি সৃষ্টিছাড়া হয়ে উঠছে লেখা। আর সবচেয়ে মারাত্মক, এতো রূপক, এতো আড়াল সত্ত্বেও সত্যি মানুষগুলো বড় বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে’।
প্রথমদিকে, বদ্ধ ঘরের অঙ্গনেই ‘থার্ড থিয়েটার’-এর কাজ বাদলবাবুর নাট্যদল ‘শতাব্দী’ শুরু করলেও পরে খোলা মাঠে অভিনয় শুরু হয়। আশির দশকে গ্রাম পরিক্রমার মধ্য দিয়ে শহর মফস্বলে আটকে থাকা নাট্যচর্চার পরিধিকে প্রত্যন্ত গ্রামেও ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলতে থাকে। সেট আলোর উপকরণগুলিকে ‘থার্ড থিয়েটার’ দর্শকের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগে অনাবশ্যক বলে মনে করে, অভিনয়ে শরীর, কণ্ঠকে নানাভাবে ব্যবহার করে তাকে জীবন্ত করার ভাবনায় এই নাট্যকলা উদ্বুদ্ধ।
ব্যয়বহুল উপকরণের নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার ফলেই এই থিয়েটার করা সম্ভবপর হয়ে উঠেছে সস্তায়, কোনো টিকিট বিক্রি, বেসরকারি বা সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভর না করেই।
‘থার্ড থিয়েটার’ এই অর্থে হয়ে উঠতে পেরেছে ‘ফ্রি থিয়েটার’ও। কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও মেহনতি সাধারণ মানুষের সংকট আর লড়াইয়ের কথাকে বারবার তুলে এনে এই থিয়েটার ‘থিয়েটারের এক নতুন রাজনৈতিক দর্শন’ তৈরি করতে পেরেছে।
থার্ড থিয়েটারের জন্যই লেখা হয়েছে, সত্তর দশক ও তার পরবর্তী বাদলবাবুর বিখ্যাত নাটকগুলো। সাগিনা মাহাতো, স্পার্টাকাস, মিছিল, ভোমা, সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস, হট্টমালার ওপারে, গণ্ডী, একটি হত্যার নাট্যকথা, নদীতে- এরা কোথাও প্রচলিত রাজনৈতিক আধিপত্যের তীব্র সমালোচনাতে উচ্চকিত। কোথাও মানুষের দাঁতে দাঁত চাপা লড়াইয়ের সঙ্গী, কোথাও নতুন মানবিক সাম্য সমাজ প্রতিষ্ঠার মরমি স্বপ্নে বিভোর!
থার্ড থিয়েটারের জন্যই লেখা তাঁর বিখ্যাত নাটকগুলি হচ্ছে- ‘সাগিনা মাহাত’, ‘স্পারটাকাস’, ‘মিছিল’, ‘হট্টমালার ওপারে’, ‘গণ্ডী’ কোথাও প্রচলিত রাজনৈতিক অধিপত্যের তীব্র সমালোচনায় উচ্চকিত, কোথাও মানুষের অদম্য লড়াইয়ের সঙ্গী, কোথাও আবার নতুন মানবিক সাম্য ও সমাজ প্রতিষ্ঠার মরমি স্বপ্নে বিভোর।
বাদল সরকারের জীবন কাহিনি নিয়ে লেখা ব্লগে নূর মোহাম্মদ নুরু বলেন, ৭২ বছর বয়সেও অভিনয় করেছেন বাদল সরকার। ‘ভোমা’ নাটকে এ বৃদ্ধ বয়সেও দাপটে অভিনয় করেছেন ঢাকায়।
১৯৬৮ সালে সঙ্গীত নাটক আকাডেমি এবং ১৯৭২ সালে ‘পদ্মশ্রী’ খেতাব পান তিনি। ১৯৯৭ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি ফেলোশিপ থেকে ভারত সরকারের সর্ব্বোচ্চ পুরষ্কার ‘রত্ন সদস্য’ পদকে তাঁকে সম্মানিত করা হয়।
তাঁর নাটক সবসময়ই বহুল আলোচিত, অভিনীত হলেও তিনি শেষ দুই দশক প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিলেন এই নাট্যকার। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১১ সালের ১৩ মে কলকাতাতে মৃত্যু হয় বাদল সরকারের।
প্রতাপ সি সাহা: শিক্ষক ও সাহিত্য লেখক