গেল বছর টেলিযোগাযোগ খাত গরম ছিল এই একটি ইস্যু নিয়েই। দুই অপারেটরের কাছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) পাওনা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় এই খাতের অস্থিরতা। আর এটি চলতে থাকে বছরের শেষ পর্যন্ত।
ইস্যুটির প্রভাব এতটা নেতিবাচক আকার ধারণ করে যে, পরিস্থিতি সামলাতে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর রবি চাকরিচ্যুতির মতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। রবির এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে কয়েকশ কর্মী চাকরি হারাবেন প্রতিষ্ঠানটি থেকে।
বছরের শুরুটাই হয় এই পাওনা নিয়ে বিটিআরসি’র আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে। বিটিআরসি গ্রামীণফোনের কাছে পাওনা ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা আর রবির কাছে ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা পরিশোধের তাগাদা দিয়ে আসছিল। কিন্তু শুরুতে বিষয়টি এতটা গুরুত্ব পায়নি। এপ্রিল মাসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিটিআরসি চেয়ারম্যান জহুরুল হক স্পষ্ট করে বলেন, গ্রামীণফোনের কাছে পাওনা ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা পরিশোধ করতেই, এক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
তার এই বক্তব্যের পরপরই গ্রামীণফোন ও রবি নড়েচড়ে বসে। চলমান ইস্যুটি পায় নতুন মাত্রা। এরপর বিষয়টি নিয়ে দুই অপারেটর ও বিটিআরসি’র মধ্যে কয়েক দফা আলোচনাও হয়। এতেও কোনো ফলাফল না আসায় পরিস্থিতি আরো নেতিবাচক দিকে মোড় নেয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দুই অপারেটর ও বিটিআরসির অনড় অবস্থানের কারণে সমস্যাটি আরো দীর্ঘায়িত হতে থাকে।
জুলাই মাসে পাওনা নিয়ে বিটিআরসি প্রথম পর্যায়ে দুই অপারেটরের ব্যান্ডউইথ কমিয়ে দেয়। পরবর্তীতে লাইসেন্স বাতিল কেন করা হবে না - এ মর্মে দুই অপারেটরকে নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। এরপর দুই অপারেটর আদালতে মামলাও করে।
এক পর্যায়ে কোনো উদ্যোগেই যেন গ্রামীণফোন (জিপি) ও রবির কাছে সরকারের পাওনা নিয়ে চলা সমস্যার সমাধান মিলছিল না, তখন বিষয়টির মধ্যস্থতা করতে মঞ্চে হাজির হন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল।।
দেশের বৃহৎ দুই মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি দ্বন্দ্ব এ খাতের জন্য নেতিবাচক প্রভাবে দুই শীর্ষ অপারেটরের ৪জি সম্প্রসারণ ব্যাহত হতে থাকে। এ অবস্থায় অর্থমন্ত্রী প্রথম এ নিয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর অপারেটরদ্বয়ের প্রতিনিধি, বিটিআরসি চেয়ারম্যান জহুরুল হক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সাথে বৈঠকে বসেন। ওই সময় অর্থমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছিলেন তিন সপ্তাহের মধ্যে বিষয়টির সমাধান হবে। এরপর মন্ত্রী তার দফতরে গভীর রাত পর্যন্ত আরো দ্বিতীয় দফা বৈঠক করেন। এরই মধ্যে তিন সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
টেলিযোগাযোগ খাতের এই ইস্যুটি নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা খোরাকও তৈরি করে। কারণ এখাতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১২ কোটি গ্রাহকের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা।
বিষয়টি নিয়ে বিটিআরসি বিলম্ব ফি সুদ মওকুফের বিষয়ে ছাড় দিতে আগ্রহ দেখালেও অপারেটরেরা এতে বিন্দুমাত্র সাড়া দেয়নি। বরং তারা অডিটকে ত্রুটিপূর্ণ আখ্য্যায়িত করে অডিট যাচাইয়ে আলাদা কমিটি গঠনের দাবি জানান। এমনকি নিয়ন্ত্রক সংস্থার নোটিশের জবাবও দেয়নি। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছে আদালতের বিচারাধীন বিষয়ে তারা কোনো নোটিশের জবাব দিতে পারে না।
এনওসি বন্ধের কারণে অপারেটরেরা কোনো যন্ত্রাংশ কিংবা কোনো নতুন প্যাকেজ চালু করতে পারছে না। এতে করে অপারেটরদের ৪জি সম্প্রসারণের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই প্রভাব পড়ছে গ্রাহকদের ওপরে।
এনওসি বন্ধ হওয়ার ফলে যখন কোন অফার বা কোন কিছু গ্রাহকদের জন্য দিতে চাইছে গ্রামীণফোন ও রবি তখন বিটিআরসি অনুমোদনও দিচ্ছে না। এতে গ্রাহকরা ওই সুনির্দিষ্ট বিষয়ে অবগত না হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।
অনেক সময় গ্রাহকদের জন্য বিশেষ ডেটা অফার থাকে। কিন্তু এনওসি বন্ধে এসব অফারের বিষয়ে তাদেরকে জানানো যাচ্ছে না। এছাড়া সম্প্রতি বন্যা কবলিত এলাকায় অপারেটরদের কাছে অনুরোধ এসেছিল, যেন ওইসব এলাকায় কলরেট কমানো হয়। তবে বিটিআরসির কাছে এ বিষয়ে আবেদন করা হলেও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি।
একাধিক বৈঠকেও গ্রামীণ ও রবি ইস্যুটির কোনো সমাধান না আসায় সম্প্রতি বিটিআরসির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম কমিশন বৈঠকে অপারেটর দুটির এনওসির বিষয়টি আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ছিল। তবে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত ছাড়াই ওই বৈঠক শেষ হয়।
এই ইস্যুটির এখানেই শেষ নয়। আরো অনেক সিদ্ধান্তও বিটিআরসি এখন আটকে দিচ্ছে অডিট সংক্রান্ত টাকা আদায় না হওয়ায়। যেমন সম্প্রতি টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা রবিকে তাদের নেটওয়ার্ক প্রান্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইমোর ক্যাশ সার্ভার বসানোর অনুমোদন দেয়নি।
গ্রাহক সেবা বাড়াতে রবি এই ক্যাশ সার্ভার বসাতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসি) এর কাছে আবেদন করেছিল। তবে রবির সঙ্গে বিটিআরসির অডিট সমস্যার কারণে বিটিআরসি ক্যাশ সার্ভার বসানোর বিষয়ে ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি।
বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, রবির আবেদন পর্যালোচনায় বসে কমিশনের ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড অপারেশন্স বিভাগ। সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত বিষয়ে মতামতের জন্য আইন বিভাগে পাঠায়। যেহেতু অডিট নিয়ে রবির সঙ্গে বিটিআরসি একটি সমস্যা রয়েছে তাই এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না নিতে অনুরোধ করে। এ কারণে বিটিআরসির সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম কমিশন সভায় রবির আবেদনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
এদিকে মোবাইল অপারেটর বাংলালিংকও ফেসবুকে ক্যাশ সার্ভার বসানোর আবেদন করেছিল। তবে তাদের বিষয়েও কোনো মতামত কিংবা সিদ্ধান্ত দেয়নি বিটিআরসি। যদিও এর আগে বিটিআরসি গ্রামীণফোন ও রবিকে ফেসবুকে এবং গুগলকে ক্যাশ সার্ভার বসানোর অনুমোদন দিয়েছিল। কিন্ত অডিট বাবদ পাওনা টাকা নিয়ে বিটিআরসি যে কঠোর অবস্থানে রয়েছে, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তা আবারো প্রমাণিত হলো।
শুধু বিটিআরসিই নয়, ইস্যুটি নিয়ে যে স্বয়ং মন্ত্রী তার অবস্থান স্পষ্ট করতে গিয়ে মোস্তাফা জব্বার এ বিষয়ে জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, বিটিআরসি অডিট করতে গিয়ে গ্রামীণফোন ও রবির ক্ষেত্রে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন, যে পদ্ধতিতে মোবাইল অপারেটরেরা সরকারকে রাজস্ব দিয়েছে, তার বাইরে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
বকেয়া টাকা আদায় করতে গিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংকটের মধ্যে পড়তে হয় জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যদি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করি, ধরা যাক টাকা না দেওয়ার জন্য গ্রামীণের লাইসেন্স বাতিল করে দিলাম। কিন্তু এতে চাপটি পড়বে দেশের জনগণের ওপর। ফলে জনগণের ব্যবস্থাটি সঠিক রেখেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি চিন্তা করতে হয়। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান টেলিটক বিকল্প হিসেবে দাঁড়ানোর সক্ষমতা অর্জন করতে পারলে অন্যদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব ছিল। তারপরও রাষ্ট্রীয় অর্থ আদায় করার জন্য আমরা আইনগত দিক থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ গ্রহণ করছি।’
অপারেটরদের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদকে বলেন, একটি বহুজাতিক কোম্পানি কখনোই চায় না এ ধরনের ইস্যু নিয়ে মামলা করতে। কারণ মামলা করা মানেই এটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তা ওই কোম্পানির জন্য দায় এবং মামলার মতো বিষয়টি বিশ্বের কাছেও সুনির্দিষ্ট কোম্পানির জন্য ইতিবাচক নয়। এতসব নেতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও আমরা এটি করতে বাধ্য হয়েছি।
এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের ক্ষমতাধর মন্ত্রীর হস্তক্ষেপেও বিষয়টির সমাধান না আসায় অনেকেই হতাশ হয়েছেন। তবে বছর শেষে আদালতের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের দিকে যাচ্ছে। গত ২৪ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট গ্রামীণফোনকে আগামী তিন মাসের মধ্যে ২,০০০ কোটি টাকা জমা দেওয়ার আদেশ দিয়েছে। রবির ইস্যুটিও একইভাবে সমাধান আসতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন: বছর জুড়ে আগুনে পোড়া ক্ষত