একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধীদল অংশগ্রহণ করেন। অংশগ্রহণমূলক এই নির্বাচনে জনগণের বিশাল ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের প্রথম বছরটি ছিল চমকে ভরপুর। রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘যে দৃশ্য কেউ কখনো দেখেনি আগে, সেই দৃশ্যই দেখানো হবে’ এই আপ্ত বাক্যের শুরুটাই হয়েছিল মন্ত্রিসভার গঠনে।
বছরের শুরুতে ৭ জানুয়ারি টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তার সঙ্গে সেদিন ৪৭ সদস্যের মন্ত্রিপরিষদের অন্যান্যরাও শপথ গ্রহণ করেন। সরকার গঠনে বয়স্ক ও বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত তরুণ ও ক্লিন ইমেজের ব্যক্তিদের স্থান দিয়ে শুরুতেই চমক ও ইতিবাচক বার্তা দেন শেখ হাসিনা।
মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন আমির হোসেন আমু, বেগম মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম, নুরুল ইসলাম নাহিদ, ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, আসাদুজ্জামান নুর, শাজাহান খান, মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়ার মতো ঝানু রাজনীতিবিদরা। যা অনেকের কাছেই ছিল অকল্পনীয়।
বছর খানেকের মধ্যে মন্ত্রিসভা বিশেষ করে নতুন মন্ত্রীদের কেউ কেউ সফলভাবে দায়িত্ব পালন করলেও অনেকে আবার বিতর্কিত কথাবার্তা, দক্ষ হাতে মন্ত্রণালয় চালানোর সক্ষমতা দেখাতে না পেরে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনার স্বীকারও হয়েছেন।
বর্তমান সরকার মেয়াদের শুরু থেকেই জঙ্গিবাদ ও মাদক নির্মূলের ঘোষণা দিয়ে সুশাসনেরও পরে জোর দিয়েছেন। হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর সরকারের তৎপরতায় দেশে থাকা বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানা একের পর এক গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। জঙ্গিবাদের মেরুদণ্ডকে ভেঙে দেওয়া হয়। জঙ্গিবাদ যখন নিয়ন্ত্রণে সরকার তখন মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধেও ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা স্পষ্ট সুরে ঘোষণা করে।
বিশেষ করে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে বেরিয়ে আসলে প্রশাসন তৎপর হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে টানা তিনবার দল ক্ষমতায় থাকায় সরকারি দলের অনেক নেতা-কর্মী অবৈধ পথে অঢেল বিত্ত বৈভবের মালিক হয়েছে বলেও বিভিন্ন সূত্রে খবর ছিল সরকারের শীর্ষ মহলে। একে একে দুই মিলিয়ে নিজ দল থেকেই শুদ্ধি অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয় ক্ষমতাসীন দল। প্রশাসন তার নাম দেয় দুর্নীতি বিরোধী অভিযান।
শুদ্ধি অভিযানের শুরুটা হয় ছাত্রলীগকে দিয়ে। ছাত্রলীগের প্রায় সাত দশকের ইতিহাসে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে এই প্রথম সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে এক সঙ্গে পদ হারাতে দেখেছে দেশ।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজ থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগে গত ৭ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার ও সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের যৌথ সভায় ছাত্রলীগের তৎকালীন শোভন-রাব্বানী কমিটির সমালোচনা করে একপর্যায়ে ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙে দিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। যার বাস্তবায়ন হয় মাত্র সাত দিনের মাথায়। ১৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী সংসদের সভায় শোভন-রাব্বানীকে পদত্যাগ করিয়ে জয়-লেখককে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এখানেই শেষ নয়! এরপরেই আসে বড় চমক। যুবলীগ নেতাদের ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি!
১৮ সেপ্টেম্বর (বুধবার) দুপুর থেকেই ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবের সামনে অবস্থান নেয় বিপুল সংখ্যক র্যাব সদস্য। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ক্লাবের ভেতরে ঢুকে র্যাব। এরপরই দেখা যায় ক্লাবের নামে সেখানে চলছে অবৈধ মদ, জুয়া আর ক্যাসিনো খেলা। ঢাকা শহরের একটি স্পোর্টসক্লাবে ক্যাসিনোর সরঞ্জামাদির দৃশ্য গণমাধ্যমে দেখে দেশবাসী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। সেদিনই সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় গুলশান-২ এর নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় ক্যাসিনোর মালিক যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে।
পরদিন ১৯ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) ছাত্রলীগের জয় লেখক গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্যসাক্ষাৎ করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগ নেতাদের উদ্দেশে বলেন, কোনো নালিশ শুনতে চাই না। ছাত্রলীগের পর যুবলীগকে ধরেছি। একে একে সব ধরব।
প্রধানমন্ত্রীর কঠোর অবস্থান ও কড়া হুঁশিয়ারির পরেই আরও কঠোরভাবে অভিযান শুরু করে প্রশাসন। অভিযান ও তদন্তে বেরিয়ে আসে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
যে সব নেতারা দাপটে এতদিন থরহরিকম্প ছিল চারদিক তাদেরই দুর্নীতি ও অবৈধ অর্থের সন্ধান একের পর এক বের হতে থাকে।
মাসব্যাপী ধারাবাহিক এই অভিযানে ধরা পড়েন যুবলীগের মহাপ্রতাপশালী নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, যুবলীগনেতা এনামুলহক আরমান, ঠিকাদার জি কে শামীম, কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম শামীম, বিসিবির পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, যুবলীগের দফতর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান ও অনলাইনে ক্যাসিনো ব্যবসার মূলহোতা সেলিম প্রধানসহ অন্তত দেড় ডজন প্রভাবশালী।
অভিযান দীর্ঘ হলে গ্রেফতারের ভয়ে আত্মগোপনে চলে যান কাউন্সিলর মমিনুলহক ওরফে সাঈদ, গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের নেতা দুই ভাই এনামুল হক এনু ও রূপন ভূঁইয়াসহ আরও অনেকেই।
অভিযানে বিতর্কিত হয়ে পদ হারাতে হয় যুবলীগের তৎকালীন চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, স্বেচ্ছাসেবক লীগের তৎকালীন স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবুকাওসার ও সাধারণ সম্পাদক পংকজ দেবনাথকে।
আওয়ামী লীগের নিজ দলের ভেতরে চলা এই শুদ্ধি অভিযান জনমনে এক ধরনের স্বস্তিও নিয়ে আসে। দুর্নীতিবাজ, রাঘব-বোয়ালরা এই অভিযানে চুপসে যান।
অভিযানের সততা নিয়ে বিএনপি প্রশ্ন তুললেও সর্বমহলে তা প্রশংসিত হয়। সাধারণ জনগণও অভিযানকে স্বাগত জানান।
আসছে নতুন বছরে এই অভিযান কোন দিকে মোড় নেয় সেটিই এখন দেখার বিষয়!