নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে আরো একটি বছর পার করছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি যা ওয়ান-ইলেভেন নামে পরিচিত। সেই দিনটি থেকেই অত্যন্ত কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দলটি।
মামলা-মোকাদ্দমায় বিপর্যস্ত শীর্ষ থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। দীর্ঘ প্রায় ১৩ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা, দলের চেয়ারপারসনের কারাভোগ, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের স্বেচ্ছায় প্রবাসে অবস্থান, ২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশ না নেয়া এবং একাদশ জাতীয় নির্বাচনে কাঙ্খিত ফল না পাওয়া-এমন নানা কারণেই সংকটের গভীরে তলিয়েছে দলটি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন আন্দোলনের জন্য যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও তা কাজে লাগাতে পারেনি বিএনপি। কেউ কেউ মনে করছেন গত এক বছরে দলটির কোনো অর্জনই নেই।
তারা বলছেন, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনটি বর্জন করলেও আন্দোলন করতে পারেনি দলটি। এছাড়াও দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্যও বড় কোনো আন্দোলন করতে পারেনি তারা।
তাছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে, বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যা, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামের ঊর্ধ্বগতি, রোহিঙ্গা ইস্যু, ভারতের জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বললেও কোনো ইস্যু নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ায়নি বিএনপি।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাই ছিলে দোটানায়। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় এবং বরাবরের মতো তত্ত্বাধায়ক সরকারের দাবিতে শক্ত অবস্থানে থাকায় তাদের নির্বাচনে অংশ নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়।
অনেকেই ভেবেছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো একাদশ নির্বাচনও বর্জন করবে দলটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করে বিএনপি।
নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে ৭টি আসনে জয়লাভ করে ঐক্যফ্রন্ট। এর মধ্যে পাঁচটি আসন পায় বিএনপি বাকি দুইটি পায় গণফোরাম। বিএনপির নির্বাচিতদের সংসদে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে শুরু হয় নানা গুঞ্জন। শেষ পর্যন্ত বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাদে বাকিরা সংসদে শপথ নেন।
বিএনপি নির্বাচন সংসদে যাওয়ার প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আন্দোলনের অংশ হিসেবেই তাদের সংসদের যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দল।
তবে অনেকেই ধারণা করছেন দলের ভাঙন ঠেকাতে তাদের সংসদে পাঠানো হয়। সে সময় তাদের সংসদে না পাঠালে তারা দল ত্যাগ করে নিজেরাই সংসদে যেতেন।
রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন ছিল নির্বাচনের পর কারাবন্দী বিএনপির চেয়ারপারসন মুক্তি পেতে পাবেন। বেগম খালেদা জিয়ার কারাবন্দীর প্রায় দুই বছর হতে চললে মুক্তির সম্ভবনা দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে।
গত ১২ ডিসেম্বর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় জামিনের শুনানি খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। যার ফলশ্রুতিতে লম্বা সময়ের জন্য কারাবন্দী থাকতে হচ্ছে বেগম জিয়াকে। তার বয়স ও শারীরিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মুক্ত অবস্থায় দেশের রাজনীতির পট পরিবর্তন বা রাজনীতিতে সরাসরি নিজের ভূমিকা রাখতে পারবেন নাকি সেটা নিয়েও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন দেশের রাজনীতি ও বিএনপির রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়ার অধ্যায়ের শেষ হয়ে আসছে।
কেননা আপিল আদালতে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ হওয়ার পরও বড় কিংবা কার্যকারী কোন কর্মসূচিতে যায়নি বিএনপি।
রায়ের আগে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলেছিলেন জামিন না হলে বুঝতে হবে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে তার মুক্তি সম্ভব নয়। তাই জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কঠোর আন্দোলনে নামতে হবে। কিন্তু কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘অসারের তর্জন গর্জনই সার’।
শত ব্যর্থতার মাঝেও চলতি বছরে বিএনপির কিছু অর্জনও রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এমনটাই মন্তব্য করেছেন। তাদের যুক্তি, দলের চেয়ারপারসনের কারাবন্দী হওয়ার পর নেতৃত্বের যে সংকট দেখা দিয়েছিল সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার মধ্য দিয়ে তা দূর হয়েছে। শুধু তাই নয় দল ভাঙনের যে গুঞ্জন উঠেছিলো সেই শঙ্কাও কাটিয়ে উঠিয়েছে বিএনপি। তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়েও নেতাকর্মীদের মধ্যে নেই কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, অনেক বাধাবিপত্তির পরেও নয়াপল্ট, সিলেটসহ কয়েকটি জায়গায় সমাবেশ করেছে বিএনপি। এসব সমাবেশে মানুষের উপস্থিত ছিলো চোখে পড়ার মত। বছরের শেষ দিকে সিলেটে ও নয়াপল্টনে পুলিশের অনুমতি না পেয়েও সমাবেশ করেছে দলটি। ছাত্রদলের নতুন কমিটি হওয়ার পর থেকেই খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিয়মিত মিছিল করছে সংগঠনটি। মধুরক্যান্টিনেও তাদেরকে দেখা যাচ্ছে প্রায়শই।
এছাড়াও সরকারের কোন উস্কানিতেই কাজ হয়নি। সরকারের ফাঁদে পা দেয়নি তারা। এমনকি বিএনপি ভাঙার যে চেষ্টা-তদবির হয়েছিল তাতেও কাজ হয়নি।
বিদায়ী বছরে বিএনপির অর্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে দলটির যুগ্ম-মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বার্তা২৪.কমকে বলেন, এ বছর বিএনপির উল্লেখযোগ্য কোন অর্জন নেই। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের যে বিক্ষোভ-অসন্তোষ, এই সরকারের ও রাষ্ট্রীয় যে অপকীর্তি সেটাকে পুঁজি করে আন্দোলনের কাজে লাগাতে পারেনি। তবে নেতৃত্বে কোন কোন্দল আছে বলে আমি মনে করি না।