দায়িত্ব নিয়ে দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) নির্বাচন ইস্যুতে বার বার বিতর্কিত হয়েছে। একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদের সমালোচনার মুখে বছর শুরু করা ইসিতে খোদ কমিশনারদের মধ্যেই কোন্দল ও মতপার্থক্য তৈরি হয়। সেই মতপার্থক্য নিয়েই বছর শেষ করছে সাংবিধানিক সংস্থাটি। নির্বাচন নিয়ে বিতর্কে জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের পক্ষে না থাকলেও কমিশনে কর্মচারী নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে সিইসি কেএম নূরুল হুদা ও সিনিয়র সচিব মো: আলমগীরের বিরুদ্ধে একাট্টা হন চার নির্বাচন কমিশনার।
গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিপুল বিজয় পায় আওয়ামী লীগ। তবে নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি। তারা নতুন করে নির্বাচনেরও দাবিও করে। আর এ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই চলতি বছরের জানুয়ারির শেষে নির্বাচন নিয়েই শুরুতেই প্রশ্ন তোলেন জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। গত ৩১ জানুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি মেয়রের শূন্য পদে স্থগিত নির্বাচন উপলক্ষে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণার্থীদের উদ্দেশে মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘আমাদের ও আপনাদের সবার কর্মকাণ্ড জনতার চোখে পরীক্ষিত হবে। সুতরাং যথার্থ একটি গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করার জন্য আমাদের সবাইকে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন খুবই সন্তোষজনক হয়েছে? এ ক্ষেত্রে পাবলিক পারসেপশন (জনসাধারণের ধারণা) কী- তা নিজেদের কাছেই জিজ্ঞেস করতে হবে।’ মাহবুব তালুকদারের এমন বক্তব্যের পরই শুরু হয় নতুন করে আলোচনা।
এরপর গত ১ এপ্রিল উপজেলা নির্বাচনের চতুর্থ পর্বের ভোট গ্রহণ শেষে ইসির তৎপরতা নিয়ে ফের প্রশ্ন তোলেন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। সেময় তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনে অনিয়মের কারণে বিভিন্ন কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ বন্ধ করা এবং অনিয়মের সঙ্গে জড়িত পুলিশ ও অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, সংসদ নির্বাচনের সময় ইসির এই তৎপরতা দেখা যায়নি কেন? ‘উপজেলা নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না। যেসব কারণে আমরা ভোটারদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছি, তার কারণ খুঁজে বের করা আবশ্যক। এ অবস্থায় ভোটারদের ওপর দায় চাপানো ঠিক নয়। গত দুই বছরে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তা নিয়ে ইসির আত্মসমালোচনা প্রয়োজন। ওই সব নির্বাচনে যেসব ভুলভ্রান্তি হয়েছে, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি রোধ করা দরকার।’ ফলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা ও মাহবুব তালুকদারের মধ্যে নানা বিষয়ে মতবিরোধ প্রকাশ্য হয়ে আসছিল। অন্য তিন কমিশনার রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও ব্রিগিডিয়ার জেনারেল (অব:) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী অবশ্য সেসব মতবিরোধ বা কোন্দলের ক্ষেত্রে বরাবরই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পক্ষ নিয়েছেন।
তবে বছর শেষে দৃশ্য পাল্টেছে। নির্বাচন নিয়ে সমালোচনায় কারো সমর্থন না পেলেও বছর শেষে নির্বাচন কমিশনে কর্মচারী নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে সিইসি কেএম নূরুল হুদা ও সিনিয়র সচিব মো: আলমগীরের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছেন চার কমিশনার। চার কমিশনারের কোনো মতামত না নিয়েই ৩৩৯ জন কর্মচারীর নিয়োগ চূড়ান্ত করায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এরপর সচিব ও কমিশনারদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। পরে এর সুরাহা না হলে দায়িত্ব ছাড়ার ইঙ্গিত দেন কোন কোন কমিশনার।
ইসি সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদাত হোসেন চৌধুরী গত ২৪ নভেম্বর সিইসি কে এম নূরুল হুদাকে একটি চিঠি দেন। তাঁরা অভিযোগ করেন, চার কমিশনারকে আর্থিক বিষয়সহ অনেক বিষয়ে জানানো হয় না। বর্তমান অবস্থায় ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর নির্বাচন কমিশনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ অনুপস্থিত। তাঁরা শুধু সিইসি ও সচিবের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। নিয়োগের বিষয়টিও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। তবে সিইসি ও সচিব মনে করেন, নিয়োগসহ কিছু বিষয় ইসির এখতিয়ারের বাইরে। এটি সচিবালয়ের দায়িত্ব। সচিব সিইসির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের কাছে দায়ী থাকবেন। সচিবালয়ের ওপর কর্তৃত্ব নিয়ে এর আগেও চার কমিশনারের সঙ্গে সিইসির বিরোধ দেখা গিয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারিতে ইসি সচিবালয়ের মাঠপর্যায়ের কার্যালয়ে ১২তম থেকে ২০তম গ্রেডের ১০টি পদে ৩৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি দেয় ইসি সচিবালয়। এতে মোট ৮৫ হাজার ৮৯৩ জন আবেদন করেন। চলতি মাসে নিয়োগ চূড়ান্ত করে নিয়োগপত্র ছাড়া হয়। এই নিয়োগ চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে চার কমিশনারের মতামত বা অনুমোদন নেওয়া হয়নি। ইসি সচিবালয়ের সচিব নথি উপস্থাপন করার পর সিইসি নূরুল হুদা তা অনুমোদন করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে অন্য চার কমিশনারকে কিছুই জানানো হয়নি। এতে তাঁরা অসন্তুষ্ট হন। নাম প্রকাশ না করে একজন কমিশনার বলেন, নিয়োগের পেছনে চার কোটি আট লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এ টাকার কোনো হিসাব নেই।
পরে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রেস ব্রিফিং করেন। ওই ব্রিফিংয়ের পরই ইসির সিনিয়র সচিবও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনো অনিয়ম হয়নি। এবং নিয়োগ কার্যক্রম কমিশনারের এখতিয়ারভুক্ত নয়। পরে ইউওনোটের জবাব গত ৯ ডিসেম্বর কমিশনারদের দেয়া হয়। ওই জবাবে কমিশনের একজন কর্মকর্তা স্বাক্ষর করেন। এ বিষয়টি নিয়ে গত ১১ ডিসেম্বর বুধবার কমিশন সভায় ক্ষুব্ধ বক্তব্য রাখেন চার কমিশনার।
সভায় একজন কমিশনার তার বক্তব্যে বলেন, নিয়োগ নিয়ে আমার এক ইউওনোটের (আনঅফিসিয়াল নোট) উত্তরে কমিশন সচিবালয় থেকে যে উত্তর দেয়া হয়েছে তা নির্বাচন কমিশনারগণের চরিত্র হননের অপচেষ্টা মাত্র। গত ৯ ডিসেম্বরের চিঠিতে আমাদের জানানো হয়েছে, নির্বাচন কমিশনারদের সুপারিশকৃত কয়েকজন পরীক্ষার্থী মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণকালে প্রক্সি পরিক্ষার্থী হিসেবে ধরা পড়েন। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে একান্ত সচিবকে মৌখিকভাবে জানানো হয়। উক্ত পরিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করা হয় এবং মৌখিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য দেখানো হয়। এ প্রসঙ্গে ওই কমিশনার সভায় বলেন, চিঠির এ উত্তর নির্বাচন কমিশনারদের প্রতি অপমানজনক।
ওই কমিশনার আরও বলেন, চিঠিতে নির্বাচন কমিশনারদের সুপারিশকৃত প্রার্থীরা নির্বাচিত না হওয়ায় তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রকার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়- সচিবালয়ের এই বক্তব্য নির্বাচন কমিশনারদের অপমান করা এবং নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ ও চ্যালেঞ্জ করার সামিল। সভায় কমিশনার বলেন, এক বছরের অধিককাল আগের এক নির্দেশ যথাযথভাবে পরিপালিত না হওয়ায় যৌক্তিকভাবেই আমি কমিশন সচিবালয়ে স্বেচ্ছাচারিতা চলে আসছে বলে উল্লেখ করেছি। কিন্তু গত ২৫ নভেম্বর সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কমিশনের অনুমোদন ব্যতিরেকে কোন কর্তৃত্ববলে প্রেস কনফারেন্স করে নির্বাচন কমিশনারদের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেকে জাহির করলেন তা বোধগম্য নয়। এমন অবস্থা চলতে থাকলে দায়িত্ব পালন সম্ভব নয় জানিয়ে এ নির্বাচন কমিশনার বৈঠকে বলেন, নির্বাচন কমিশন ও কমিশন সচিবালয়ের মধ্যে সমন্বয় না থাকলে কোন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তবে সচিবালয়ের বর্তমান স্বেচ্ছাচারিতা ও মিথ্যাচারের বিহিত না হলে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন প্রায় অসম্ভব।
ওই সভায় ইসি সচিবালয়ের চিঠি প্রসঙ্গে আরেক নির্বাচন কমিশনার বলেন, উত্তরপত্রটিতে সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সরাসরি কমিশনারদের মুখোমুখি করার একটা প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়েছে। তিনি বলেন, কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের অনুস্বাক্ষরসহ অত্যন্ত আপত্তিকর ভাষায় যে উত্তর দেয়া হয়েছে তা সকল কমিশনারকে হতবাক করেছে। কেননা উল্লেখিত পত্রে কমিশনারদের প্রদত্ত ইউওনোটকে সম্পূর্ণরূপে পাশ কেটে অপ্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। নিয়োগ প্রসঙ্গে এ কমিশনার বলেন, নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় যথাযথ নিয়ম অনুসরণ না করার বিষয়টি আড়াল করে নির্বাচন কমিশনারদের হেয় করার প্রয়াস মাত্র- যা মোটেই কাঙ্খিত নয়। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি নষ্ট হলে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সকল কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হবে। শেষ বক্তব্যে এ কমিশনার বলেন, সিইসি সকল নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সু-সম্পর্ক বজায় রেখে বিদ্যমান সকল আইন অনুসরণ করে কমিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন- এমন প্রত্যাশা করেন এ কমিশনার। একইভাবে আরও দুই কমিশনার সচিবালয়ের কাজ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
আর সর্বশেষ গত ২৫ ডিসেম্বর নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার চেয়ে মাহবুব তালুকদার বরিশাল, গাজীপুর ও খুলনা সিটির ভোট নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ‘অতীতে যে সকল সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে, তাতে প্রথম দুটি নির্বাচন- কুমিল্লা ও রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমাদের সফলতা ছিল। বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমি এককভাবে দায়িত্ব পালন করি এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে আমি প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে এই তিনটি নির্বাচনের স্বরূপ সন্ধান করি। কিন্তু এই তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আমার কাছে মোটেই সুখকর নয়। আসন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিগত ওই তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না।’