দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন বছর আগমনের বার্তা। আর এর মধ্য দিয়ে একটি ক্যালেন্ডার বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিচার-বিশ্লেষণ চলছে গত হতে যাওয়া বছরের নানা কর্মকাণ্ডের।
২০১৯ সালে এক দিকে যেমন বহুল-প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল দৃশ্যমান হয়েছে, তেমন ঘটেছে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও। আর এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মধ্যে বছর জুড়ে অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল ‘গুজব’।
বছর জুড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল একটি কুচক্রীমহল। চলতি বছরের বিভিন্ন সময় তৈরি হওয়া উল্লেখযোগ্য গুজবগুলো হল- পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে, লবণের দাম বৃদ্ধি, নিখোঁজ স্যাটেলাইট, ভুয়া নোট, মোটরযান আইন, ও বিদ্যুৎ বন্ধ।
এসব গুজবে যেমন বছর জুড়ে জনমনে সৃষ্টি করেছে আতঙ্ক, তেমনি গুজব ছড়িয়ে একটি শ্রেণী ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে।
পদ্মা সেতুতে মাথা লাগার গুজব (ছেলে ধরা গুজব)
বছরের শুরুর দিকে না হলেও মাঝামাঝি সময়ে রীতিমত আতঙ্কে রূপ নেয় ছেলেধরা গুজব। এপ্রিল-মে মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ায় পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণে মানুষের রক্ত ও মাথা লাগবে। আর এই মাথা ও রক্তের যোগান দিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থেকে ছেলে ধরা হচ্ছে বলে গুজব রটে। এই গুজবটি মুহূর্তের মধ্যেই দেশব্যাপী আলোড়ন ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন। ছেলেধরা গুজবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আহত ও নিহত হওয়াদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নারী, মানসিক রোগী, প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধাসহ নিরীহ মানুষ।
তবে ছেলে ধরা গুজবে সব থেকে বেশি আলোচিত হয় তসলিমা বেগম রেনু হত্যা। গত ২০ জুলাই বাড্ডায় মেয়েকে স্কুলে ভর্তির তথ্য জানতে এসে তসলিমা বেগম রেনু ছেলেধরা গুজবের শিকার হয়ে গণপিটুনিতে নিহত হন।
রেনুর এমন হত্যার বিষয়টি সর্বত্র আলোড়ন সৃষ্টি করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দফতর, র্যাবের পক্ষ থেকে ছেলেধরা গুজব বন্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। যদিও প্রশাসনের এমন পদক্ষেপের পরও ছেলেধরা গুজব রটিয়ে বেশ কয়েকজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
ছেলেধরা গুজবের তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ছেলেধরা অভিযোগে যতজনকে হত্যা করা হয়, তারা কেউই অপরাধী ছিলেন না। রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে এ গুজব রটানো হয় বলে দাবি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।
লবণের দাম বৃদ্ধির গুজব
চলতি বছরের শেষ দিকে এসে পেঁয়াজের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যেই গুজব রটে লবণের দাম বৃদ্ধির। নভেম্বর মাসে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী গুজব ছড়ায় পেঁয়াজের মতোই দাম বাড়ছে লবণের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পরে। রাজধানীসহ সারা দেশে ক্রেতারা মুদির দোকানে ভিড় জমায় লবণ কিনতে। জন প্রতি ১০-১৫ কেজি লবণ কেনেন অনেক ক্রেতা।
তখন ক্রেতারা বলেন, পেঁয়াজ ছাড়া খাবার খাওয়া গেলেও লবণ ছাড়া কীভাবে খাবেন? তাই অতিরিক্ত দামের বোঝা এড়াতে মজুদ করার জন্য লবণ কিনেন তারা।
যদিও সরকারের যথেষ্ট ভূমিকায় এক দিনের বেশি স্থায়ী হয়নি গুজবটি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ নিজেই লবণ উৎপাদন করে এবং তা পরিমাণে যথেষ্ট। লবণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আমদানির ওপর নির্ভরশীল নয়। এছাড়া দেশের বড় বড় কোম্পানিগুলোও যথেষ্ট মজুদ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে। যার ফলে গুজবটি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিল সরকার।
তবে গুজবটি একদিন স্থায়ী হলেও দেশব্যাপী যথেষ্ট আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পেরেছিল লবণের দাম নিয়ে।
নিখোঁজ স্যাটেলাইট
২০১৯ এর নভেম্বর মাসে সৃষ্টি হওয়া আরেকটি গুজব হল ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিখোঁজ’। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে এসে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিখোঁজ’ শিরোনামে একটি খবর বেনামী কিছু ওয়েবপোর্টাল ও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে৷ পরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ‘গুজব প্রতিরোধ ও অবহিতকরণ সেল এক বিবরণীতে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিখোঁজ’ শিরোনামের খবরটি গুজব বলে নিশ্চিত করে।
মোটরযান আইন
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সংশোধনী মোটরযান আইন অনুযায়ী জরিমানার পরিমাণ সর্বোচ্চ এক হাজার গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে বলে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে৷ ফেসবুকের সেই পোস্টটিতে দেখা যায়, মোটরযান আইন (সংশোধনী) ২০১৯ লিখা একটি পোস্টে আগের আইনের সঙ্গে নতুনের আইনের শাস্তি ও জরিমানার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়।
আর এই গুজবটিও ফেসবুকের কল্যাণে নেটিজেনদের (ইন্টারনেট সিটিজেন) কাছে ছড়িয়ে পড়ে। পরে এক পর্যায়ে গুজবটি সরকারের দৃষ্টিতে আসে। তখন সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিষয়টি ঠিক নয়। এটি একটি গুজব।।
ভুয়া নোট
এক পাশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অন্য পাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ছবি সম্বলিত নতুন ১০০ টাকার নোট বাজারে আসছে বলে সেপ্টেম্বর মাসে গুজব ছড়ায়। পরে সেই নোটের একটি ছবিও ছড়িয়ে যায় ফেসবুকে৷ পরে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায় এই তথ্য ভুয়া৷
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, শেখ হাসিনার ছবিযুক্ত কোনো নোট তারা ছাড়েনি। এ ধরনের নোট ছাড়ার কোনো সিদ্ধান্তও নেই তাদের। বিষয়টি সম্পূর্ণ গুজব।
বিদ্যুৎ বন্ধ
চলতি বছরের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে ছড়িয়ে পরে ভিন্ন ধর্মী একটি গুজব। ২৩ জুলাই থেকে ময়মনসিংহের গফরগাঁওসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে টানা তিন দিন বিদ্যুৎ থাকবে না বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। পরে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বলা হয়, টানা তিন দিন ধরে বিদ্যুৎ থাকবে না বিষয়টি সম্পূর্ণ গুজব। গুজবটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তেমনি বেশি সারা না ফেলতে পারলেও ময়মনসিংহের গফরগাঁওসহ দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলের বাসিন্দারা বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন।
বছর-জুড়ে দেশব্যাপী চলা নানা গুজবের বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের ক্ষোভ, সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া ও বিচার ব্যবস্থার ওপর অবিশ্বাসের কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সরকারের সঠিক পদক্ষেপ ও নেটিজেনদের সচেতনতার অভাবকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন কুচক্রীমহল গুজব সৃষ্টি করছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারকে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ জনকে একত্রিত করে গুজবের বিষয়ে কাজ করতে হবে। না হলে শুধুমাত্র ২০১৯ সাল নয়, নতুন বছর ২০২০ সালেও ভিন্ন ধরনের গুজব রটিয়ে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করবে বিভিন্ন মহল।