নতুন সরকারের প্রথম বছর অর্থাৎ ২০১৯ সাল ‘পুঁজিবাজার ভালো থাকবে’ এমন প্রত্যাশা ছিলো বিনিয়োগকারীদের। ২০১০ সালের ধসের আট বছর পর আবারও ব্যবসায় ফিরবে ব্রোকারেজ হাউসগুলো। দশ বছর পর প্রাণ ফিরবে পুঁজিবাজারে। বিনিয়োগকারীরাও তাদের হারানো পুঁজি পুষিয়ে নিবে। শেয়ার ব্যবসার পাশাপাশি মতিঝিলের এলাকার হোটেল এবং মোবাইল ব্যাংকিংসহ সব ধরনের ব্যবসায় ফিরবে চাঙ্গাভাব।
প্রত্যাশা অনুসারে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় দেশের দুই পুঁজিবাজার ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই ও সিএসই) লেনদেন হয়। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের ‘প্রত্যাশায় ছাই পড়ে’ জানুয়ারির ২৭ তারিখ থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় সূচক পতন। তার সঙ্গে যোগ হয় দুর্বল কোম্পানির শেয়ার পুঁজিবাজার থেকে তালিকাচ্যুত করার উদ্যোগ। উৎপাদনহীন তার ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বৃদ্ধি ‘জেড’ ক্যাটাগরির এমন কয়েকটি কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়। আর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পুঁজিবাজারে। শুরু হয় ডিএসইর ওপর নিয়ন্ত্রক সংস্থার চাপ।
এরমধ্যে বেরিয়ে আসে কোম্পানিগুলোর প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) অনৈতিক প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের খবর। তার সঙ্গে নতুন করে যোগ হয় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে আসা বিনিয়োগকারীদের টিআইএন নম্বর বাধ্যতামূলক করবে এনবিআর। এরপর এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, বিনিয়োগকারীদের টিআইএন নম্বর বাধ্যতামূলক নয়।
এভাবেই চলে যায় টানা তিন মাস। এই সময় জুড়েই চলে টানা দরপতন। দরপতনে বিনিয়োগকারীদের নতুন করে পুঁজি উধাও হয় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এই পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করার পরিবর্তে ২২ এপ্রিল উল্টো বলেন, ‘পুঁজিবাজারের অবস্থাকে আমি খারাপ বলবো না। এটা ঠিক আছে, ভালো আছে। পুঁজিবাজারে এখন কোনো প্রবলেম নেই। আমি তো পুঁজিবাজারের অবস্থা ঠিকই আছে দেখলাম।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, পুঁজিবাজারে কাউকে জোর করে আনতে পারবেন না। কেউ আসতে চাইলে আসবে। না আসলে নেই। মার্কেট খারাপ আমরা দেখি না। এখানে মার্কেট চলে আপনাদের দ্বারা। আপনারাই চালাচ্ছেন। আপনারা যেভাবে চালান মনে হয় যেনো বাজারই নেই। যেভাবে এঁকে (অঙ্কন করে) দেখান তাতে মনে হয় বাংলাদেশে শেয়ার মার্কেটই নেই। কি যে এঁকে দেখান তা আমি বুঝি না। এমন বক্তব্যের পর বাজার আরও বেশি দরপতনে নিমজ্জিত হয়।
এগুলো কাটিয়ে উঠতে না উঠতে ২০১৯-২০ অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণা। অর্থমন্ত্রী এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করেন বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া হবে। বাজেট ঘোষণা হয়। তাতে বেশ কিছু প্রণোদনাও দেওয়া হয়। কিন্তু বাজেটে কোনো কোম্পানি বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিলে কোম্পানিগুলোকে ১৫ শতাংশ কর প্রদান করতে হবে এমন প্রস্তাবের পর আবারও শুরু হয় দরপতন।
ঠিক এই সময়ে অর্থমন্ত্রী আবারও বলেন, পুঁজিবাজার ছাগল ও সিংহের বাজার। এখানে ছোট বিনিয়োগকারীদের ছাগল আর বড় বিনিয়োগকারীদের সিংহের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, এই বাজারে ৫০ কোটি নয় আরও ৫ লাখ কোটি টাকা দিলেও খেয়ে ফেলবে। এখানে ৫-১০ লাখ কোটি টাকা দিয়ে কোনো লাভ নেই। অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর আবারও শুরু হয় দরপতন।
তার সঙ্গে যোগ হয় নতুন করে বকেয়া পাওনা গ্রামীণফোনের সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিটিআরসির দ্বন্দ্ব। আর এই দ্বন্দ্বের ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির হিড়িক পড়ে।
এসব কারণে দরপতন ধসে পরিণত হয়। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি দেশি ক্ষুদ্র, ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বাজার ছাড়তে থাকে। দরপতনের প্রতিবাদে মতিঝিলের রাস্তায় নামে বিনিয়োগকারীরা। তারা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেনের পদত্যাগ দাবি করেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি।
২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারির পর থেকে থেমে থেমে দরপতন চলছে। এই পতনে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৫ লাখ ৭৮ হাজার বিনিয়োগকারীর পুঁজি ৮৩ হাজার কোটি টাকা উধাও হয়েছে। টানা ১১ মাস ২০১০ সালের চেয়ে বড় ধসে রূপ নিয়েছে। এই ধসে শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার ব্যক্তি চাকরি হারিয়েছে। লোকসান কমাতে ব্রোকারেজ হাউসগুলো শতশত শাখা অফিস বন্ধ করেছে। এখন বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ কোনো রকম পুঁজি নিয়ে পুঁজিবাজার ছাড়তে চাই।