সাভারের আশুলিয়ায় বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও পানিবাহিত রোগে কাতর এখানকার পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষ। এদের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছে ডায়রিয়া, জন্ডিসসহ নানা রোগে। জীবন যুদ্ধে বেঁচে থাকার আশায় এ অঞ্চলে পাড়ি জমানো অনেকেই রোগে আক্রান্ত হয়ে দিন পার করছে নিদারুণ কষ্টে। গভীর নলকূপ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় একদিকে যেমন বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সামগ্রীর অভাব অন্যদিকে ডায়রিয়ার প্রকোপ, এ যেন মরার ওপর খরার ঘাঁ।
কর্মের তাগিদে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা মানুষগুলোর সামান্য আয়ে পার করতে হয় দিন। আয় ব্যায়ের হিসাব কষে খরচ কমাতেই তারা কম ভাড়ায় বসবাস করেন এসব নিম্নাঞ্চলে। কিন্তু চলমান করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এমনিতেই স্বাভাবিক আয় থেকে কমেছে প্রায় অর্ধেক। করোনার দাপটে ভঙ্গুর যখন তাদের সংসার, তখনই নতুন করে বন্যার দূষিত কালো পানি বিষিয়ে তুলেছে তাদের স্বাভাবিক জীবন। দূষিত কালো পানিতে বন্দি এসব পরিবারের সদস্যরা ডায়রিয়া, জন্ডিসসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে হারিয়ে ফেলেছে সাহস। শিশু সন্তান নিয়ে যাপন করছেন নির্ঘুম রাত।
মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) আশুলিয়ার বাইপাইল, কাইচাবাড়ি, ও শিমুলিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় কয়েক হাজার পরিবার দূষিত পানিতে বন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। খাদ্য সংকটসহ চিকিৎসা সংকটে কাটছে তাদের দিন। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা পড়েছে সবচেয়ে বেশি বিপাকে। তাদের বাসা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় অন্যের বাসায় সাহায্য নিতে হয় বার বার। তাদের এখনো কোনো সহযোগিতা কিংবা পাশে এসে দাঁড়ায় নি কেউ। এমন অভিযোগ করে কেঁদে ফেলেছেন এসব বানভাসির অনেকেই। ভুগছেন খাদ্য ও প্রয়োজনীয় ওষুধের সংকটে।
প্রায় মাস খানেক হলো পানিবন্দি হয়ে অসহায় দিন যাপন করছেন বৃদ্ধ মাসহ বাইপাইলের সাকিল খাঁনের পরিবার। কখনো অন্যের বাসায় খালি মেঝেতে, কখনো দুর্গন্ধযুক্ত কালো হাঁটু পানির মধ্যে চৌকিতে বসে করেছেন রাত পোহাবার অপেক্ষা। তার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে রাতে ভাল ঘুমাতে পারি না। ঠিক মতো বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের কষ্ট নিয়ে দিন পার করেছি। পাশে দাঁড়ানোর মতো কোনো লোক এখনও খুঁজে পাই নি। আমি আমার মাকে নিয়ে অনেক অসহায় অবস্থার মাঝে আছি। চারপাশে ডায়রিয়া ও জন্ডিসের রোগী। আমিও এখন ভয়ে আছি।
অপর পানিবন্দি সালেহা বলেন, বন্যার এই দূষিত পানির কারণে আমার ডায়রিয়া হয়েছে দুই দিন ধরে। বাসায় হাঁটু পানি। আমি মেয়ে মানুষ, মানুষের বাসার বাইরে যেতে পারছি না। ওষুধ পত্রও পর্যাপ্ত নেই। খাবার স্যালাইন দোকান থেকে কিনে খাচ্ছি। এখন একটু সুস্থের দিকে। তবে স্থানীয় কোনো জনপ্রতিনিধি এখন পর্যন্ত আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায় নি। আমরা খুব কষ্ট ও অসহায় বোধ করছি। জীবন যুদ্ধে মনে হয় আমরা পরাজিত।
পানিবন্দি শ্রমিক লিটন বলেন, আমাদের কারখানা খোলা। বন্যার পানি উঠে ঘর ভরে গেছে। রান্নার কোনো স্থান কিংবা ব্যবস্থা নেই। সকালে রুটি ও কলা খেয়ে অফিস যাই, দুপুরেও খাবার ব্যবস্থা হয় না। রাতে এসে হোটেলে কিংবা চিড়া কিনে খেয়ে দিন পার করছি। লজ্জায় কাউকে কিছু বলতেও পারছি না, আর খিদের জ্বালা সইতেও পারছিনা। হোটেলে তিন বেলা খাবার খেলে কমপক্ষে ২৫০ টাকা লেগে যায়। প্রথম কয়েক দিন খেয়ে টাকা শেষ হয়ে গেছে। ঈদের ভাংতি মাসের বেতন পেয়ে দোকানের বাকি পরিশোধ করতেই টাকা ফুরিয়ে গেছে। আবারও পড়েছি একই অবস্থায়।
বন্যার পানিতে ডুবে গেছে রিয়াজ উদ্দিনের চায়ের দোকান। হাসান বার্তা২৪.কমকে বলেন, প্রায় ২৫ দিন হলো দোকান বন্ধ। কোনো ইনকাম নাই, বাচ্চারা এক বেলা না খেয়ে থাকলে খুব কষ্ট হয়। ঠিকমতো বাজার করতে পারছি না। আমরা কোনো সময় না খেয়ে থেকে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছি। এ অবস্থার মধ্যে এক সন্তান ডায়রিয়ায় ভুগছি। সন্তানের রোগ মুক্ত না হতেই আবার আমার স্ত্রীরও হয়েছে ডায়রিয়া। দু মুঠো খেতে পারছি না, ভাল চিকিৎসা করাবো কিভাবে। বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। হয়তো কয়েক দিনের মধ্যেই দোকান খুলতে পারবো। কিন্তু খোলার সাথে সাথেই তেমন বিক্রি হবে না। সব মিলিয়ে হতাশায় ভুগছি।
সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.সায়েমুল হুদা জানান, বন্যার্তদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য আমরা মেডিকেল টিম গঠন করেছি। আমাদের পর্যাপ্ত খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও প্রয়োজনীয় ওষুধ মজুদ আছে। স্থানীয় কমিউনিটি ক্লিনিকে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় সেবা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ২৪ ঘণ্টা খোলা রয়েছে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসলে যেকোনো পরিস্থিতিতে পর্যাপ্ত সেবা প্রদান করা হবে। এছাড়াও আমাদের মেডিকেল টিম প্রস্তুত রয়েছে খবর পাওয়া মাত্র রোগীদের পাশে গিয়ে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করবে।
এ ব্যাপারে সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেগম শামিম আরা নিপা জানান, সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যাক্তির মাধ্যমে পাওয়া তথ্যমতে উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়েছে। আমরা সরকারি সহায়তা হিসেবে চাল, গো-খাদ্য ও শুকনো খাবার পেয়েছি, বন্যার্তদের ক্ষতির পরিমাণ অনুযায়ী পানিবন্দিদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও খাবার স্যালাইন বিতরণের কাজটি স্বাস্থ্য বিভাগ করছেন।
এছাড়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলকে নির্দেশনা দেওয়া আছে, পানিবন্দি যে কোন এলাকায় যদি বিশুদ্ধ পানির ঘাটতি থাকে তাহলে তারা দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন। আমাদের পর্যাপ্ত পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও ম্যান পাওয়ার আছে। রিপোর্ট পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্তত বিশুদ্ধ পানির ঘাটতি হবে। অনেক সময় খবর আমাদের কাছে আসে না। তবে খবর পাওয়া মাত্র আমরা ব্যবস্থা নেবো। এ ধরনের সমস্যায় সরাসরি যোগাযোগ করার জন্য আহ্বান জানান এই কর্মকর্তা।