কুষ্টিয়া: অবসর গ্রহণ করেছেন ২০০৭ সালে। তবে এখনো নাসির মাস্টার তার কাঁধে ঝোলানো লম্বা ফিতার ব্যাগের মধ্যে স্লেট এবং চক নিয়ে ঘুরে বেড়ান অশিক্ষিত মানুষের দ্বারে দ্বারে। তাদের ভেতরে শিক্ষার আলো জ্বালাতে নিরলস পরিশ্রম করছেন তিনি। এলাকার মানুষের কাছে জ্ঞানের বাগান হিসেবে পরিচিত এই শিক্ষাগুরু।
১৯৪৬ সালে কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের কয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নাসির উদ্দিন। আলোকিত এই মানুষটি ১৯৬৯ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
২০০৭ সালে সাদামনের মানুষ নাসির মাস্টার অবসর গ্রহণের পর পেনশনের টাকা দিয়ে নিজ হাতে গড়ে তোলেন শিশুদের জন্য বিনোদন পার্ক, হরেক রকমের ফুল, ফল ও ঔষধি গাছের বাগান। সঙ্গে রয়েছে তার মায়ের নামে নামকরণ করা ‘কুলছুম নেছা শিশু পার্ক ও পাঠাগার’।
জীবনের শেষ অর্জনটা দিয়ে শিক্ষার প্রদ্বীপ জ্বালিয়ে নাসির মাস্টারের বাড়ি এখন শিশুতোষ জ্ঞান ভান্ডারে রূপ নিয়েছে।
পাঠাগার ও পুরাতন তথ্যবহুল পেপার কাটিং এবং মনীষীদের বাণী প্রভৃতির বিশাল সংগ্রহশালা যেন তার বাড়িটি আলোকিত করে রেখেছে। এই শিক্ষাগুরুর বাগানে রয়েছে হরেক রকমের ফুল-ফল আর ঔষধি গাছ। প্রায় ৪০ বছর ধরে এই বাগানের পরিচর্যা করে আসছেন তিনি।
নাসির উদ্দিন শুধুমাত্র শিশুদের পাঠ্যবই’ই পড়ান না, তাদের আরও পড়ানো হয় বিভিন্ন ধরনের শিশুতোষ গল্পের বইও। নাসির মাস্টারের বাগানে বসে শিশুরা ছবিও আঁকে। বর্তমানে শুধু এলাকার মানুষই নয়, দূর-দূরান্তের অনেকেই প্রয়োজনে ছুটে যান নাসির মাস্টারের বিনোদন বাগানে। কেননা তিনি বহু পুরাতন পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ও প্রবন্ধের কাটিং সংরক্ষণ করে রেখেছেন।
যার মধ্যে রয়েছে গুণী মনীষীদের জীবনীসহ নানাবিধ তথ্যসমূহ। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সমূহের ফাইলগুলো সর্বস্তরের মানুষের জন্যে উন্মুক্ত করে রেখেছেন তিনি। বসত বাড়ির একটি কক্ষে রয়েছে নিজের মায়ের নামে নামকরণ করা কুলছুম নেছা পাঠাগার। পাঠাগারটিতে বইয়ের পাশাপাশি রয়েছে বিশ্ব বিখ্যাত গুণী ব্যক্তিদের তথ্য ও ছবি।
নাসির মাস্টারের সহধর্মিণী মরিয়ম বেগম জানান, এই বাগানেই শিশুরা খেলা করে আর নানা ধরনের বই পড়ে। শিশুদেরকে প্রতিটি গাছের সঙ্গে পরিচিত করতে কাগজে নাম লিখে লেমেনেটিং করে তা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়াও গুণী মনীষীদের বাণী কাগজে লিখে লেমেনেটিং করে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছেন গাছে গাছে।
তিনি আরও জানান, দেশীয় নানা প্রজাতির পাখির সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যও কাজ করেছেন নাসির উদ্দিন। বাগানের বড় গাছগুলোতে পাখিদের বাসা বানানোর জন্য হাঁড়ি ঝুলিয়ে রেখেছেন তিনি। পাখিদের গোসলের জন্য বাগানের ভেতরে একটি জায়গায় পানি রেখেছেন। শিশুরা স্কুল শেষ করে বিকেলে চলে আসে এখানে। অনেকে দোলনায় বসে খেলা করে। অন্যান্য খেলার সামগ্রী নিয়েও ব্যস্ত থাকে কেউ কেউ। অনেকে মাটিতেই খেলতে শুরু করে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নানা ধরনের খেলা। শিশুরা যেন বাংলা শব্দের শুদ্ধ উচ্চারণ করতে পারে সেজন্যও শিক্ষা দেয়া হয় তাদের।
নাসির মাস্টার বলেন, ‘আমি দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় নিজের গ্রামে শিক্ষার হার বাড়ানোর জন্যে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। সেখানে এলাকার বিভিন্ন বয়সের অশিক্ষিত মানুষকে মৌলিক বর্ণমালা শিক্ষা দান করা হত।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমার এই কাজে সহযোগিতা করেন সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রকিবুল হাসান ও মিলন হাসানসহ গ্রামের কিছু ব্যক্তিরা। আমি এই কাজগুলো করার মাঝে আনন্দ খুঁজে পাই। আর শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতেও আমি খুব পছন্দ করি। আমি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চাই।’