সন্ধ্যা নামলেই কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে

, জাতীয়

ইমাম খাইর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কক্সবাজার | 2023-08-23 06:49:00

কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পে কিশোর গ্যাং আতঙ্ক ভর করেছে। সন্ধ্যা নামলে খোলা মাঠ ও এক ভবন থেকে অন্য ভবনে ঘুরে বেড়ায় বখাটেরা। তাদের কারণে অনিরাপদ হয়ে গেছে সেখানকার ওঠতি বয়সী তরুণীদের চলাচল।

ইতোমধ্যে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ ও মারধরের ঘটনা ঘটেছে কয়েকবার। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিচার দিলেও প্রতিকার মেলে না। উল্টো দোষারোপ করা হয়। তাই চিন্তিত-উদ্বিগ্ন অসহায় ৬০০ পরিবার।

এদিকে, গত সপ্তাহ দু’য়েক ধরে এরকম অভিযোগ আসার পরে সরেজমিন গিয়ে কথা হয় আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের সাথে। তারা জানিয়েছে দুঃখের কথা।

আশ্রয়ণ প্রকল্পে রয়েছেন ৬০০ পরিবার। ছবি: বার্তা২৪.কম

কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে প্রধানমন্ত্রীর গড়ে দেওয়া বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই আশ্রয়ণ প্রকল্পটি। যেখানে ৬০০ উদ্বাস্তু পরিবারের স্থান হয়েছে।

প্রবাল ভবনের ৫০৬ নং ফ্ল্যাটের বাসিন্দা সায়রা বেগম (৪৫) জানান, স্বামী ও ৩ সন্তানসহ সেখানে তাদের বসবাস। ছেলে রবিউল আলম (১৬) কে স্থানীয় ১০/২০ জনের কিশোর গ্যাং মিলে বিনা কারণে মারধর করে। এমনভাবে মেরেছে যে, মলদ্বার দিয়ে পায়খানা বেরিয়েছে। অমানুষিক নির্যাতিত হয়েও ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায়নি ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা। ঘটনাটি সপ্তাহখানেক আগের।

একই সময় সোপান ভবনের ৩০৬ নং ফ্ল্যাটের বাসিন্দা মুহাম্মদ হানিফ (৩৮) নামের আরেক যুবককে ছুরিকাঘাত করেছে খুরুশকুলের কিশোর গ্যাং। বিচার দিয়ে প্রতিকার পাননি। উল্টো আসামি করা হয়েছে।

আরও পড়ুন➥ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৬০০ পরিবার

ঘটনার বর্ণনায় হানিফ জানিয়েছে, স্থানীয় কিছু বখাটে প্রায় সন্ধ্যায় তাদের ভবনের দরজা-জানালা লক্ষ্য করে বৈদ্যুতিক টর্চলাইট মারে। যে কারণে ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা ভয় পেয়ে যায়। এমন না করতে বলায় তার ওপর চড়াও হয় বখাটেরা। সংঘবদ্ধ হয়ে তাকে মারধর ও ছুরিকাঘাত করে। এ ঘটনায় মুবিন, আরমান, বাবুল, মিন্টু নামের আরো বেশ কয়েকজন আহত হন।

বখাটেদের কারণে লোকজন অতিষ্ঠ। ছবি: বার্তা২৪.কম

কামিনী ভবনের ৪০৬ নং ফ্ল্যাটের বাসিন্দা জেসমিন (৩৫) আকতারের অভিযোগ, তার মেয়ে উম্মে হাফসা কক্সবাজার সিটি কলেজের একাদশের ছাত্রী। পরিবারের খরচ যোগাতে পার্শ্ববর্তী একটি বাড়িতে প্রাইভেট পড়াতে যেত মেয়ে। কিন্তু বখাটেদের কারণে তা বন্ধ হয়ে গেছে। ছেলে রাকিবও ভয়ে বাসা থেকে বের হয় না।

তিনি জানান, স্থানীয় একজন টমটম চালক মেয়ে উম্মে হাফসাকে উত্যক্ত করে আসছিল। প্রতিবাদ করায় তাকে ধরে নিয়ে ধর্ষণেরও হুমকি দিয়ে যায় ওই বখাটে। তবে অভিযুক্ত বখাটের নাম জানাতে পারেন নি জেসমিন।

কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ে কাপড়-চোপড় নিয়ে চলে গেছেন কামিনী ভবনের ৩০৮ নং ফ্ল্যাটের হাশেম উদ্দিন। জানালেন তার সত্তরোর্ধ বয়সী মা মুহছেনা।

এসব ঘটনার পর থেকে খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রতিকার চায় ভুক্তভোগীরা।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুরাইয়া আকতার সুইটি জানান, সম্প্রতি এমন কিছু ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। ঘটনাগুলো তারা সমাধান করেছেন। এসব বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন, জনগণ, জনপ্রতিনিধি ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের সাথে বসে করণীয় ঠিক করেছেন।

ইউএনও জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় পুলিশ টহল বাড়ানো হয়েছে। শিগগিরই এখানে একটা অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প হবে। এখন এ বিষয়ে প্রস্তুতি চলছে।

আঘাতের যন্ত্রণায় সারারাত ছটফট করলেও হাসপাতালে যেতে সাহস পাননি নজরুল। ছবি: বার্তা২৪.কম

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বস্তির কুঁড়েঘরে থাকা জলবায়ু উদ্বাস্তুরা এত ভালো ডিজাইনের দামি ফ্ল্যাটে থাকবে এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না এই প্রকল্পের আশপাশের গ্রামবাসী ও রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ব্যক্তিরা। এ কারণে তারাই এই প্রকল্পের বাসিন্দাদের মারধর করছে, ভয় দেখাচ্ছে। যাতে তারা এখানে আর না আসে। কিংবা নামমাত্র মূল্যে ফ্ল্যাটের মালিকানা বিক্রি করে অন্য কোথাও চলে যায়। তবে কে বা কারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে তাদের সঠিক পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি।

এদিকে, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের অভাব অভিযোগের কথা শুনতে ১৮ অক্টোবর আশ্রয়ণ প্রকল্পে ছুটে যান কক্সবাজার পৌরসভার সংরক্ষিত ওয়ার্ডের (১,২,৩) কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র শাহেনা আকতার পাখি। সে সময় তার সঙ্গে দেখা প্রতিবেদকের।

স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছে অভিযোগ দিচ্ছেন বাসিন্দারা। ছবি: বার্তা২৪.কম

শাহেনা আকতার পাখি জানান, খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার ফসল। জলবায়ু উদ্বাস্তুদের প্রতি তিনি আন্তরিক বলেই এত বিরাট কাজটি করেছেন। কিন্তু ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের প্রতি প্রতিনিয়ত এমন ঘটনার সংবাদ খুবই দুঃখজনক। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৬০০ মানুষের জীবনের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনের দাবি তুলেন কাউন্সিলর পাখি।

আরও পড়ুন➥ পানির কষ্টে খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা 

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষগুলোর জন্য প্রধানমন্ত্রী গড়ে তোলেন খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প। কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার উত্তরে বাঁকখালী তীর ঘেঁষে নির্মিত হয়েছে ২০টি দৃষ্টিনন্দন ভবন।

ফ্ল্যাটের এক বাসিন্দা। ছবি: বার্তা২৪.কম

গত ২৩ জুলাই গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রথম ধাপে তৈরি ২০টি ভবনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আশ্রয়ণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রামু ১০ পদাতিক ডিভিশন। এখানে নির্মাণাধীন ১৩৭টি পাঁচতলা ভবনের প্রতিটিতে ৬৫০ বর্গফুট আয়তনের ৩২টি করে ইউনিট (ফ্ল্যাট) থাকছে। সেখানে আশ্রয় নেবে ৩২টি করে পরিবার।

এ প্রকল্পে ১০ তলার আরেকটি দৃষ্টিনন্দন ভবন হচ্ছে। ভবনটির নামকরণ হয়েছে ‘শেখ হাসিনা টাওয়ার।’

খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পে যাতায়াতের জন্য বাঁকখালী নদীর ওপর তৈরি হচ্ছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৯৫ মিটার দীর্ঘ সেতু ও সংযোগ সড়ক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর