‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’- চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কারাগারের এই স্লোগান শুধু দেয়ালেই সীমাবদ্ধ। দুর্নীতি যেন এ কারাগারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে! বন্দীদের নির্যাতন, সাক্ষাৎ-বাণিজ্য, সিট-বাণিজ্য, খাবার-বাণিজ্য, চিকিৎসা-বাণিজ্য এবং জামিন-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করে কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কারারক্ষীদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারার অভিযোগে উঠেছে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কারাগারে প্রথম বন্দীদের যেখানে রাখা হয় তাকে ‘আমদানি কক্ষ’ বলা হয়। পরে বন্দীদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ‘বিক্রি’ করা হয়। ওয়ার্ড নিয়ন্ত্রণ করে পুরাতন বন্দী ও কারারক্ষীরা। ওয়ার্ড থেকে হাসপাতালে চিকিৎসার নামে বিক্রি হয়। হাসপাতালে থাকতে প্রতি মাসে ৫/৬ হাজার টাকা প্রদান করতে হয়। অন্যান্য ওয়ার্ডে থাকতে দিতে হয় ৩-৪ হাজার টাকা। কারা কর্মকর্তাদের অর্থ দিয়ে ওয়ার্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয় পুরনো বন্দীরা। বর্তমানে জীবন নামে এক ম্যাট ‘আমদানি কক্ষ’ নিয়ন্ত্রণ করছে।
করোনাভাইরাসের অজুহাতে আমদানি কক্ষে আটকিয়ে রাখা হয় বন্দীদের। আবার ২৫০০ টাকা দিলেই অন্য ওয়ার্ডে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। কারা কর্তৃপক্ষ ঘুষের টাকা পরিবারের কাছ থেকে বিকাশে গ্রহণ করেন। বন্দীরা অর্থ দিতে ব্যর্থ হলে তাকে আমদানি কক্ষেই রেখে দেয়া হয়। এছাড়াও বন্দীদের দেয়া হয় মানহীন খাবার। এসব নিম্নমানের খাবার সরবরাহের সঙ্গে কারারক্ষী, ডেপুটি জেলার এবং জেলার সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
কারাগারের নিয়ন্ত্রণে দুটি ক্যান্টিন রয়েছে। একটি কারাগারের ভেতরে, অন্যটি বাইরে। বাইরের ক্যান্টিনে কোন মূল্য তালিকা নেই। ভেতরের ক্যান্টিনের পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক। দুই ক্যান্টিনেই সিগারেট, কলা, বিস্কুট, কেক আপেলসহ অন্যান্য প্রতিটি পণ্যের দাম বেশি নেয়া হচ্ছে। বন্দীদের পিসিতে ১ হাজার পাঠালে ২০ টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়। অথচ রশিদে লেখা হয় ১ হাজার টাকা। ভেতরের ক্যান্টিনে ক্রয়কৃত মালামালের বিপরীতে মূল্য পিসি (প্রিজনার ক্যাশ) কার্ড থেকে কর্তন করা হয়। শুধুমাত্র কর্তনকৃত মোট টাকার পরিমাণ থাকে। কোন পণ্যের নাম লেখা থাকে না।
নির্ভরযোগ্য সূত্র ও জামিনে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসা একাধিক বন্দী জানিয়েছেন- কারাগারের প্রতিটি ওয়ার্ড ইজারা দেয়া হয়। ম্যাট, সিও ম্যাট, সিআইডি ম্যাট, পাহারাদার ও ওয়ার্ড রাইটার এসব ওয়ার্ড বরাদ্দ নিয়ে থাকে। নির্দিষ্ট ইজারা মূল্য কারা কর্তৃপক্ষকে পরিশোধ করতে বাধ্য করে।
জানা গেছে, মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় কারাবন্দীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ বন্ধ রয়েছে। তবে প্রতিদিনই জনপ্রতি ৩-৪ হাজার টাকা নিয়ে স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। অফিস কল এবং সাক্ষাৎকালে টাকা আদায়ের সঙ্গে কারারক্ষী, প্রধান কারারক্ষী ও ডেপুটি জেলার জড়িত। পরবর্তীকালে এই টাকা জেলার এবং জেল সুপারের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিদিন সন্ধ্যায় কারাগারের সামনে জামিনপ্রাপ্ত আসামির স্বজনদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে দেখা যায়। জামিনপ্রাপ্ত আসামির স্বজনদের কাছ থেকে বিভিন্ন কৌশলে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। বন্দীরা আদালত থেকে জামিনলাভ করলেও অর্থ প্রদান না করলে জামিননামা আটকিয়ে রেখে মুক্তি বিলম্বিত করা হয়। এর জন্য সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা দিতে হয়।
অভিযোগ আছে, বন্দীদের খাবার, স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ, কারাগারে ভালো স্থানে থাকার ব্যবস্থা- এ সবকিছু চলে টাকার বিনিময়ে। টাকার বিনিময়ে সোনা চোরাকারবারি ও মাদক কারবারিরাও কারাগারে বিলাসী জীবনযাপন করে। কারাগারকে বলা হয় সংশোধনাগার। সেখানে অপরাধীদের রাখা হয় কৃত অপরাধের সাজা প্রদানের পাশাপাশি সংশোধনের উদ্দেশ্যে। সেই কারাগারেই চলছে নানা ধরনের অপরাধকর্ম।
জেলার ও ডেপুটি জেলারের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে এই অনিয়ম ও দুর্নীতির সিন্ডিকেট। অন্তত ৩-৪শ’ বন্দীর কাছে মাসে সর্বনিম্ন ২ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড ভাড়া উত্তোলন করা হয়। অবৈধভাবে উত্তোলনকৃত বেড ভাড়ার নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা কারা কর্তৃপক্ষের পকেটে যায়। বাকি টাকা ম্যাট, পাহারাদার ও ওয়ার্ড রাইটারদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ আদালতের এক আইনজীবী জানান, আদালত থেকে আসামির জামিনাদেশ পাওয়ার পরও কারা কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে কালক্ষেপণ করে থাকে। বিভিন্ন সময় দাড়ি-কমার ভুল দেখিয়ে নানা অজুহাতে আসামি প্রতি দুই-তিন হাজার টাকা দাবি করে। ঘুষের টাকা না দিলে মুক্তি দিতে টালবাহানা করে। প্রতিনিয়ত এ ধরনের ধৃষ্টতা দেখিয়ে থাকে কারা কর্তৃপক্ষ।
কারাগারে অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলার ইসমাইল হোসেন বলেন, এগুলো ভুয়া কথা। এসব অভিযোগ সঠিক নয়। তাছাড়া আমি তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা নই, এ বিষয়ে জেল সুপারের সঙ্গে কথা বলেন।
জেল সুপার মুজিবুর রহমান মজুমদার জানান, এসব বক্তব্য তো ফোনে দেয়া যায় না। অফিসে আসেন তথ্য অধিকার আইনে যতটুকু সম্ভব তথ্য দেয়া দেয়া যাবে। অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এক সময় এসব অনিয়ম কারাগারে হতো বলে শুনেছি। তবে এখন এ কারাগারে কোন অনিয়ম হয় না।