কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর বাসিন্দারা খাবার পানির জন্য প্রধানত অগভীর নলকূপ, পুকুর ও নদীর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এসব উৎসের পানি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শরীরের জন্য অনিরাপদ এবং জৈব ও রাসায়নিক- উভয়দিক থেকেই মানুষের খাবারের অনুপযোগী হয়ে থাকে। লবণাক্ততার হার বেড়ে যাওয়ায় মিঠাপানির প্রাপ্যতাও সেখানে ক্রমশ কমে আসছে। এসব কারণে মহেশখালীর স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে, বিশেষত নারী ও শিশুদেরকে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। কারণ কেবল দূরবর্তী জায়গায় গিয়ে পানি সংগ্রহ করার জন্যই তাদেরকে দিনে ৪-৫ ঘণ্টা ব্যয় করতে হয়। এতে কর্মক্ষম নারীদের উৎপাদনশীলতা কাজে লাগানোর সুযোগ যেমন নষ্ট হয়, তেমনি শিশুরাও শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
এছাড়া অনিরাপদ পানি পানের কারণে সেখানকার মানুষ ব্যাপকহারে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় এবং মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফলে সার্বিকভাবে তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যায়। পানিবাহিত রোগের প্রকোপের পাশাপাশি এই দ্বীপ উপজেলার মানুষজন গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল প্যাথোজেনস বা ক্ষতিকর জীবাণুর আক্রমণে পেটের নানান রোগে আক্রান্ত হন। যা সার্বিকভাবে তাদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি ক্ষমতাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়।
"বিশুদ্ধ পানি ও নিরাপদ খাওয়ার পানি পাওয়ার মতো কোনো নির্ভরযোগ্য উৎস ছিল না। তখন জীবন ছিল ভীষণ কঠিন। আমার মতো অনেক নারীকেই তাদের পরিবারের পানির চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা হেঁটে দূর-দূরান্ত থেকে পানি আনতে হতো। এাছাড়া আমাদের ছেলে-মেয়ে সহ পরিবারের অন্য সদস্যদেরকে পেটের অসুখ সহ প্রতিনিয়ত নানান পানিবাহিত রোগে ভুগতে হতো।
আজ সে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এখন আর পানি আনতে দূরে যেতে হয় না। বসতঘরের কাছেই বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাওয়ার পানি পাচ্ছি। কথাগুলো বলছিলেন, কক্সবাজার জেলার দূরবর্তী দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর প্রত্যন্ত গ্রামের গৃহিনী সুফিয়া খাতুন।
সম্প্রতি সমন্বিত টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো সেবা প্রদানকারী কোম্পানি ইডটকো বাংলাদেশ, বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা ‘ব্র্যাক’ এর সহযোগিতায় মহেশখালীর প্রত্যন্ত এলাকায় রিভার্স অজমোসিসভিত্তিক ‘ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ বা পানি পরিশোধন প্ল্যান্ট উদ্বোধন করেছে।
এতে করে সুফিয়া খাতুন ছাড়াও কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর এক হাজারেরও বেশি সংখ্যক পরিবারের জন্য নিরাপদ খাবার পানি নিশ্চিত হয়েছে।
সম্প্রতি ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকল্পটি উদ্বোধনের সময় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এর ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র, ইডটকো বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজিং ডিরেক্টর রিকি স্টেইন এবং ব্র্যাকের কমিউনিকেবল ডিজিজেস অ্যান্ড ওয়াটার, স্যানিটেশন অ্যান্ড হাইজিন (ওয়াশ) প্রোগ্রামের ডিরেক্টর মো. আকরামুল ইসলাম সহ অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ইডটকো যেসব জায়গায় টাওয়ার স্থাপন করে তার আশপাশের জনগোষ্ঠী, বিশেষত: স্থানীয় সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার উন্নয়নে সহায়তা প্রদান করতে ইডটকো সামাজিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারই অংশ হিসেবে মহেশখালীতে স্থাপিত টাওয়ারের আশপাশের জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহে দু’টি পানির প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। প্ল্যান্ট দু’টি স্থাপন করা হয়েছে মহেশখালীর উত্তর মেহেরিয়াপাড়া জামে মসজিদ এবং কুতুবজম মডেল হাই স্কুলে। ইডটকোর টাওয়ার-টু-কমিউনিটি (টিটুসি) কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) আওতায় স্থাপিত প্রকল্প দু’টির আশপাশের দরিদ্র ও অতিদরিদ্র প্রায় ১,০০০ পরিবার প্ল্যান্টগুলো থেকে সহজেই নিরাপদ খাবার পানি সংগ্রহ করতে পারবে। কাজেই নিরাপদ খাবার পানির দুষ্প্রাপ্যতা নিরসনের মাধ্যমে স্থানীয় অধিবাসীদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার ক্ষেত্রে প্রকল্প দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। টেকসই প্ল্যান্ট দু’টি থেকে তারা বিনামূল্যে কিংবা ভর্তুকি মূল্যে নিরাপদ খাবার পানি সংগ্রহ করতে পারবেন। ব্র্যাকের ওয়াশ প্রোগ্রামের (ইজঅঈ ডঅঝঐ চৎড়মৎধসসব) সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে গৃহিত এই প্রকল্প দু’টি মহেশখালীর প্রত্যন্ত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ ও তার নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতের পাশাপাশি করোনা ভাইরাস সহ অন্যান্য রোগ-জীবাণু থেকে রক্ষা পেতে হাত ধোয়ার বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করবে।
এ প্রসঙ্গে ইডটকো বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজিং ডিরেক্টর রিকি স্টেইন বলেন, ''সামাজিকভাবে একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইডটকো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। নিরাপদ খাবার পানির নিশ্চয়তা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৬ (এসডিজি-৬) অর্জনে বাংলাদেশের যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, সেটি পূরণে সবার জন্য নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, ব্র্যাকের সহযোগিতায় নেওয়া এই অংশীদারিত্বমূলক প্রকল্প মহেশখালীর প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দাদের, বিশেষত: নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যগত উন্নতি নিশ্চিত করবে।''
ব্র্যাকের কমিউনিকেবল ডিজিজেস অ্যান্ড ওয়াটার, স্যানিটেশন অ্যান্ড হাইজিন (ওয়াশ) প্রোগ্রামের ডিরেক্টর মো. আকরামুল ইসলাম বলেন, ''কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ইডটকোর সাথে যৌথভাবে আমরা নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রকল্প চালু করেছি। এতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মানুষ, বিশেষ করে- নারী ও মেয়েশিশুরা ভীষণ উপকৃত হবে। নিরাপদ পানির চরম সঙ্কটে রয়েছে এমন জনগোষ্ঠীর সহায়তার লক্ষ্যে আমাদের গৃহিত প্রচেষ্টায় শরিক হওয়ার জন্য আমরা ইডটকোকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। এই উদ্যোগ স্থানীয় অনেক পরিবারকে পানিবাহিত রোগের প্রকোপের পাশাপাশি কোভিড- ১৯ মহামারীর সংক্রমণ থেকে রক্ষা করবে।"