প্রমত্তা পদ্মার বুকে ‘স্বপ্ন জয়ে আখ্যান’

, জাতীয়

মানসুরা চামেলী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 01:06:23

পদ্মা সেতুতে ১২ ও ১৩ নম্বর পিয়ার বা খুঁটির ওপর বসানো হলো ৪১ তম স্প্যান। বহুল কাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পূর্ণাঙ্গ অবয়বে মাথা তুলে দাঁড়ালো। আর এর সঙ্গে সঙ্গে প্রমত্তা পদ্মার বুকে বিজয়ের মাসে লেখা হয়ে গেলো আরেকটি ‘ঐতিহাসিক জয়ের আখ্যান’।

দুপুর ১২টা ২মিনিট, ১০ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার; দিনটাকে ঐতিহাসিক না বলে পারা যাচ্ছে না। পদ্মার ওপর এই জয়ের আখ্যান লেখা শুরু হয়েছিল ২০১২ সালের ১০ জুলাই। বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এদিন ‘কার কাছে হাত পেয়ে সহায়তা নয়, নিজস্ব অর্থায়নে’ পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপর কত সমালোচনা, গুজব, বাধা বিপত্তি, সর্বগ্রাসী পদ্মাকে বাগে আনার সাফল্যসহ মহাকাব্য রচনা করে আজকের এই সাফল্যের দিনটি এলো।

বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এদিন ‘কার কাছে হাত পেয়ে সহায়তা নয়, নিজস্ব অর্থাযনে’ পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন

পদ্মা সেতুতে প্রথম স্প্যান বসানো শুরু হয় ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। তিন বছরে বসলো ৪১টি স্প্যান। সবশেষ ৪১ তম স্প্যানটি বসানোকে ঘিরে পদ্মা পাড়ে আজ ছিলো উচ্ছ্বাসের আমেজ। উচ্ছ্বাস তো হবে, তীরবর্তী এসব মানুষের কেউ কেউ বছরের পর বছর পদ্মার কড়ালগ্রাসে হারিয়েছেন সর্বস্ব। আজ তারাই দেখছেন উত্তাল পদ্মাকে হারিয়ে স্থাপন হয়েছে ‘এক জয়ের নিশান’।

তবে পদ্মার পাড়ের মানুষের এ উচ্ছ্বাস শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর। ওইদিন নির্মাণে কাজের উদ্বোধনের পর থেকেই সেতুর নির্মাণ কাজ নিয়ে আগ্রহ উত্তেজনা ছিল মানুষের মধ্যে। সেই থেকে সেতুকে ঘিরে স্বপ্ন বুনছে পদ্মার পাড়সহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। তো আজকের দিনটা তাদের কাছে শুধু ঐতিহাসিক না, নানা দিক থেকে গুরত্বপূর্ণও বটে!

পদ্মা সেতুতে প্রথম স্প্যান বসানো শুরু হয় ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর।

তবে এই সাফল্যের কর্তৃত্ব যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের উপর। প্রধানমন্ত্রীর এই দৃঢ় অঙ্গীকারের ফলে নানা সমালোচনা ও দুর্গম পথ অতিক্রম করে আজ বিশাল কর্মযজ্ঞের শেষ প্রান্তে বাংলাদেশ। জয় করেছেন দুর্নীতির অপবাদ ঘুচিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ভৌগলিক বিভেদ।

‘পদ্মা সেতু আমাগো গর্বের সেতু। সরকার বিরাট কাম ঘটাইছে। ভাবা যায়না সেতু বাস্তব হচ্ছে। আমরা ১৫ বছর ধরে মাওয়া ঘাটে ফল বিক্রি করি। সেতু হলে হয়ত এখানে থাকতে পারব না। কিন্তু পদ্মা সেতু যে দ্যাশের অহংকার। কত মানুষের উপকার হবে। আমি একটা করে খাওয়ার ধান্দা ঠিক করে নিবোনে। সেতু হওয়াতে বলে বোঝাতে পারবনা কতটা খুশি।’

গোটা দুনিয়াকে জানান দিলো-১৬ কোটি মানুষের দেশটি শুধু স্বপ্ন দেখেই না, মাথা উঁচু করে সেই পূরণ করতেও পারে

পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের সরজমিনে রিপোর্ট করতে গিয়ে প্রতিবেদকের কাছে এভাবে নিজের ভাব প্রকাশ করলেন মাওয়া ঘাটের ফল বিক্রেতা আনোয়ার হোসেন। আজকে হয়ত আনোয়ার হোসেনের মতো অনেকের দূর থেকে বিশাল পদ্মার বুকে দুই পার জুড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে গর্বে বুকে ছাতিটা বড় হচ্ছে। আচ্ছা এই স্বপ্ন জয় কি শুধুই গর্বের, নাকি দীর্ঘ যাত্রার এই গল্পটা বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের মাথা আরেকবার উঁচু করলো। গোটা দুনিয়াকে জানান দিলো-১৬ কোটি মানুষের দেশটি শুধু স্বপ্ন দেখেই না, মাথা উঁচু করে সেই পূরণ করতেও পারে।   

পদ্মা সেতুতে স্বাধীনতার সূর্বণ জয়ন্তীতে যান চলাচল

বর্ষায় প্রবল ঢেউয়ে উত্তাল পদ্মা, গ্রীষ্মে কাল বৈশাখী ঝড়ের চোখ রাঙানি আর শীতে ঘুন কুয়াশা- এর প্রভাবে ফেরি চলাচল বিঘ্ন-বন্ধ; পদ্মা পাড়ি দিতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের এসব নিত্য সঙ্গী। উফ! স্বপ্ন সেতু তো হয়েই গেল! বাকি আনুসাঙ্গিক কাজ, অপেক্ষা আর মাত্র এক বছর। সরকার ঘোষণা দিয়েছে ২০২১ সালের স্বাধীনতার সূর্বণ জয়ন্তীতে পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হবে।    

২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটির ওপর প্রথম স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু। আজকে ৪১ তম স্প্যান বসানোর মাধ্যমে মিলন ঘটেছে সেতুর মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত আর শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের। এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের ২৯ জেলার সঙ্গে ঢাকার সহজ যোগাযোগের পথ উন্মুক্ত হচ্ছে। আর পদ্মার পাড় ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ এখন ‘ভৌগোলিক বিভেদ’ ঘুচানোর অপেক্ষায় প্রহর গুনবে।

সরকার ঘোষণা দিয়েছে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতার সূর্বণ জয়ন্তীতে পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হবে

দ্বিতলবিশিষ্ট পদ্মা সেতুতে এসব স্প্যান বসছে ৪২টি পিয়ার বা খুঁটির ওপর। স্প্যানের ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন আর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) সমীক্ষায় জানানো হয়, পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচল করবে প্রায় ২৪ হাজার যানবাহন।

এরইমধ্যে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উন্নয়নের নানা উদ্যোগ চলছে। সেতু এলাকা ও আশপাশে এরই মধ্যে কলকারখানা স্থাপনের উদ্যোগ চোখে পড়ছে। দেশের অর্থনীতিতেও এই সেতুর প্রভাব হবে উল্লেখযোগ্য। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মানুষের জীবনযাত্রার মানও বাড়াবে বলে ধারণা অর্থনীতিবিদদের।

মূল সেতুর বাস্তব কাজের অগ্রগিত ৯১ শতাংশ, নদীশাসন কাজের ৭৫.৫০ শতাংশ, সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এলাকার কাজের শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮২.৫০ শতাংশ। রেল ও গাড়ি চলাচলের রাস্তা নির্মাণের অংশ হিসেবে পৃথকভাবে স্লাব বসানোর কাজ জোরগতিতে এগিয়ে চলছে। তাছাড়া সংযোগ সড়কের কাজ শেষ হয়েছে অনেক আগেই।

মূল সেতুর বাস্তব কাজের অগ্রগিত ৯১ শতাংশ, নদীশাসন কাজের ৭৫.৫০ শতাংশ, সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এলাকার কাজের শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে

পদ্মা সেতু প্রকল্পে উভয় তীরে সংযোগ সড়ক ১৪ কিলোমিটার। নদীশাসনের এলাকা ১২ কিলোমিটার। পদ্মা সেতুতে বসবে দুই হাজার ৯১৭টি সড়ক স্লাব। এরই মধ্যে বসানো হয়েছে এক হাজার ২৮৫টি স্লাব। মাওয়া ও জাজিরার সংযোগ সেতুতে বসাতে হবে ৪৮৪টি সুপারগার্ডার। এর মধ্যে বসানো হয়েছে ৩১০টি। রে ল সড়কের জন্য আলাদা স্লাব বসানো হচ্ছে।

মূল সেতুর দৈর্ঘ্য হয় ৬.১৫ কিলোমিটার। দুই পারে আরো ৩.১৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়কসহ সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৯.৩০ কিলোমিটার। চার লেনের সেতুর প্রস্থ ৭২ ফুট। সেতুর মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে যানবাহন সেতুতে ওঠার জন্য এবং সেতু থেকে নামার জন্য দুই দিকে ভাগ করা হয়েছে সংযোগ সড়ক। এটি মূলত ভায়াডাক্ট বা ডাঙায় সেতুর অংশ। দুই প্রান্ত মিলিয়ে সেতুর এই অংশের দৈর্ঘ্য ৩.১৫ কিলোমিটার।

পদ্মা সেতুর নকশা করেছে আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম এইসিওএম নামের একটি প্রতিষ্ঠান

পদ্ম সেতু বহুমুখী প্রকল্প

পদ্মা সেতুর নকশা করেছে আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম এইসিওএম নামের একটি প্রতিষ্ঠান। নির্মাণকাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পানি (সিএমবিইসি)। নদীশাসনের কাজ করছে চীনের সিনো হাইড্রো করপোরেশন। সেতু ও নদীশাসনের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে। মাওয়া ও জাজিরায় পদ্মার উভয় তীরে সংযোগ সড়কের নির্মাণকাজ যৌথভাবে করছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেড ও মালয়েশিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এইচসিএম। সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এলাকার পরামর্শক হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কার্স অর্গানাইজেশন।

পদ্মা সেতুর সংশোধন করে ধরা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এসে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয় ৩০ হাজার ১৯৩.৩৯ কোটি টাকা। গত ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পে মোট খরচ হয়েছে ২৪ হাজার ১১৫.০২ কোটি টাকা। ব্যয় আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

আরও পড়ুন: পদ্মা সেতু: বিজয়ের মাসে আরেক বিজয়

পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যান বসানোর কর্মযজ্ঞ চলছে

পদ্মা সেতুর ৪১টি স্প্যানের আদ্যোপান্ত

প্রমত্তা পদ্মার বুকে ‘স্বপ্ন জয়ে আখ্যান’

হয়ে গেলো পদ্মা সেতু!

এ সম্পর্কিত আরও খবর