মাশরুম প্রকল্প কার জন্য ?

, জাতীয়

শ্যামলী তঞ্চঙ্গ্যা | 2023-08-31 22:19:02

গত বছরের ২৭ অক্টোবর অনলাইনে মাশরুম চাষী ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে ‘মাশরুম চাষের সমস্যা, সম্ভাবনা ও সমাধান’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় আমাদের মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, মাশরুম চাষের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে শিগগিরই উদ্যোগ নেয়া হবে। মাশরুমের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে গবেষণা বাড়াতে হবে বলেও জানান তিনি।

কৃষিমন্ত্রী আরো বলেন, গবেষণা করে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও সিজনভিত্তিক নতুন জাতের মাশরুম উদ্ভাবন করতে হবে এবং চাষ সম্প্রসারণ করতে হবে। মন্ত্রী মহোদয়ের এই সুন্দর আশাবাদকে মাশরুম সংশ্লিষ্টরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাবে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, কোথায় কার জন্য কে করবে এই গবেষণা ?

এর আগেও বিভিন্ন মেয়াদে বিভিন্ন প্রকল্পে জাতীয় মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট প্রায় একশ কোটি টাকা খরচ করেছে। মাশরুম উন্নয়ন প্রকল্প ছিলো উন্নয়ন প্রকল্পের মডেল। সবাই মাশরুম প্রকল্পকে মারহাভা দিচ্ছিলো। কৃষি বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের বড় কর্তারা খুশি, অবসরে যাওয়া কর্মকর্তারাও খুশি, তাদের বিবি সাহেবেরা খুশি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট প্রফেসররা খুশি। কেউ খেয়ে খুশি, কেউ নিয়ে খুশি, কেউ এমনি-এমনিই খুশি।

আপনারা হয়ত প্রশ্ন করবেন- আচ্ছা প্রকল্প ভিজিট করলেই কি ওঁরা দু’হাত ভরে দেয়? না সবাইকে ওঁরা দেয়না। যোগ্যতা অনুযায়ী আপনি পাবেন। আপনি কত বড় কর্তা সেটির ওপর ভিত্তি করে আপনি পাবেন। আপনি অবসরে যাওয়া কর্তা ব্যক্তি হলে আপনার সাথে ক্ষমতাশীল কর্তা ব্যক্তিদের সাথে ভালো খাতির থাকতে হবে। অথবা এমন একটা ভাব করবেন যে ডিজি সাহেবের সাথে তো আমার মাঝে-মাঝেই দেখা হয়। অথবা বলবেন, এইতো পরশুই ডিজি মহোদয়ের সাথে দেখা হলে আপনাদের প্রকল্পের সফলতার গল্প আলাপ করবো। কেউ যদি বলতে পারেন, মাননীয় কৃষি মন্ত্রীর সাথে আমার সখ্যতা আছে- তার সাথে সাক্ষাৎ হলে বলবো- আপনারা খুব ভালো করছেন; তাহলে আপনার হয়েই যাবে! অনেকে একদম ভনিতা পছন্দ করেন না। এরা রসিকও বটে।

হঠাৎ নাটকীয় ভাবে স্নেহের সুরে প্রকল্প পরিচালককে বলবে, তোমাদের সাভারে নাকি ভালো খাসির মাংশ পাওয়া যায়! প্রকল্প পরিচালক বলবে, হ্যাঁ স্যার আপনি ঠিকই বলেছেন। এ সময় গুপ্ত মানিব্যাগ বের করে টাকা বের করতে উদ্যত হতেই প্রকল্প পরিচালক বলবে স্যার লজ্জা দেবেন না, এতদিন পর এসেছেন। স্যার কয় কেজি লাগবে ? এ সময় গুপ্ত বলবেন, আট-দশ কেজি। প্রকল্প পরিচালক কলিং বেল টিপে তার দক্ষ অ্যাটেনডেন্স কে বাজারে পাঠাবে।সাভার নামা-বাজারে খাসির মাংশের সাথে ল্যাংড়া বাছুরের মাংশ সস্তায় পাওয়া যায়। আর এসব মাংশ কেনার দায়িত্ব পেলে অ্যাটেনডেন্সেরও হয়ে যায়।

আচ্ছা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি কোন উন্নয়ন প্রকল্প ভিজিট করেছিলেন ? কেননা তিনি লিখেছিলেন- ‘যদি জোটে রোজ- এমনি বিনি পয়সার ভোজ। ডিশের পরে ডিশ- শুধু মটন কারি ফিস, সঙ্গে তারি হুইস্কি সোডা দু-চার রয়াল ডোজ। পরের তহবিল-চোকায় উইলসনের বিল- থাকি মনের সুখে হাস্যমুখে, কে কার রাখে খোঁজ।’

রবীন্দ্রনাথ ঠিকই লিখেছেন, কেউ কারো খোজ রাখেনি। মাশরুম উদ্যোক্তা আর চাষীর খোজ কেউ রাখেনি। মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট গবেষণার নামে উন্নয়ন কর্মকর্তা ও কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের বায়োডাটা প্রলম্বিত করেছে। উন্নয়ন প্রকল্পের কারিগরদের পিএইচডি ডিগ্রি দিয়ে বিনিময়ে কোন-কোন প্রফেসর এখানে তার গবেষণার বিষয়ে ল্যাবরেটরি তৈরি করতে উৎসাহিত করেছে। এইসব ল্যাবরেটরি থেকে বাংলাদেশের মাশরুম উদ্যোক্তারা কিছু পাবেনা। অথচ এইসব সুবিধাভোগী চতুর প্রফেসর ক্ষমতাশীনদের খুব কাছে চলে যেতে পারে।

যেমন মাশরুম প্রকল্পের দুর্দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে আয়োজিত বোটানিক্যাল সোসাইটির কনফারেন্সে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীকে প্রধান অতিথি করা হয়। কৃষিমন্ত্রী অনুষ্ঠান উপলক্ষে অল্প সময়ের জন্য এলেও এক চতুর প্রফেসর তার কানে মাশরুম প্রকল্পের সাফাই গেয়ে আবার প্রকল্প অনুমোদনের অনুরোধ করে। কিন্তু বিধি বাম! এইসব সুবিধাবাদীদের খুব ভালো করে চেনেন অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী। মুহূর্তেই প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি মাশরুম প্রকল্প নিয়ে অগ্নিঝরা বক্তব্য দেন। মঞ্চে উপবিষ্ট মাশরুম প্রেমী প্রফেসর এবং মঞ্চের বাইরে মাশরুমের স্টল সাজিয়ে বসে থাকা মাশরুমের উপ-পরিচালক ও মাশরুম বিশেষজ্ঞরা মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজে পায়নি।

এমন ঘটনা মন্ত্রণালয়েও নাকি ঘটেছে। দুর্নীতি ও নানাবিধ অপকর্মের কারণে মাশরুম উদ্যোক্তা ও চাষীদের তোপের মুখে নাজেহাল যখন মাশরুম প্রকল্প এমনি সময়ে একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর সামনে বলে বসলেন, ‘মাশরুম প্রকল্প তো বেশ ভালো করছে।’ মন্ত্রী নাকি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বলেছিলেন, ‘তাই নাকি ! ওঁরা খুব খাইয়ে-টাইয়ে দিয়েছে আপনাকে, চেহারা তো জ্বল-জ্বল করছে।’

অভার-ডোজে আপ্যায়ন, লাগামহীন কেনাকাটা, ভাউচার বাণিজ্য এবং মাশরুম উদ্যোক্তাদের প্রতি উদাসিনতায় মুখ থুবরে পড়েছিলো জাতীয় মাশরুম প্রকল্প।

পাঁচ বছর আগের গল্প এগুলো। উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য আরো বরাদ্দ ছিলো ছিয়াত্তর কোটি টাকা। প্রকল্পটি এ-টেবিল সে-টেবিল করে মন্ত্রণালয়ের সবুজ পাতায় পৌছে গিয়েছিলো। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী স্বাক্ষর করে দিলেই সেটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে অনুমোদনের জন্য যেতো।

দুই দশক আগে রাঙামাটিতে মাশরুম প্রকল্প চালু হলে সেখানেও ব্যাপক দুর্নীতি হয়, রাঙামাটি ঢাকা থেকে অনেক দুরে ছিলো বলে নাকি খোজ-খবর নেয়া সম্ভব হয়নি। তাহলে কৃষি বিভাগের নাকের ডগায় অবস্থিত সাভারের মাশরুম প্রকল্পের বেহাল অবস্থা কি অতিরিক্ত খোজ-খবর নেয়ার কারণে হয়েছে!

একজন মাশরুম প্রেমী হিসেবে আমি মাশরুম উন্নয়ন প্রত্যাশী। সত্যিকার অর্থেই যদি ভালো কাজের সুযোগ থাকে তবে সেটি হোক, নয়তো সাধারণ মানুষকে মিথ্যা আস্ফালন প্রতারণা করা ঠিক নয়। প্রকল্পের নামে আবার কানার হাটবাজার যেন না বসে সেদিকে কৃষি বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি কামনা করছি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর