‘আমাগো মতো শ্রমিকদের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নাই’

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’
  • মেহেদী হাছান মাহীম, বার্তা ২৪. কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

‘আমাগো মতো শ্রমিকদের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নাই’ এমন বুকভরা আক্ষেপ নিয়ে নিজের কষ্টের কথা প্রকাশ করেছেন ষাটোর্ধ্ব বয়সের তছিরন বেগম। স্বামী অনেক আগে মারা গেলেও ছেলেই ছিল তার একমাত্র ভরসা। এখন সেই ছেলেও অসুস্থ। পরিবারের সকল দায়িত্ব এখন তছিরন বেগমের উপর। পরিবারের দায়িত্ব মেটাতে তছিরন বেগম এখন কাজ করছেন রাজধানী ঢাকার গাবতলী এবং আমিন বাজারের মধ্যস্থল দিয়ে বয়ে যাওয়া তুরাগ নদী সংলগ্ন কয়লা ব্যবসা কেন্দ্রে। দিনে বারো ঘন্টা মাথায় করে বোঝাই করে কয়লা টানার কাজ করেও তেমন কোনো টাকা পায়না তিনি। এরকম ঝুকিপূর্ণ কাজে জীবনেরও নেই কোনও নিশ্চয়তা।

পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। ১৮৮৬ সালে এদিনে শ্রমিকরা আমেরিকার শিকাগো শহরে তাদের কর্মক্ষেত্রে দৈনিক ১২ ঘণ্টার পরিবর্তে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন করেছে। সেদিন আন্দোলনের একপর্যায়ে পুলিশ শ্রমিকদের উপর পুলিশ গুলি করতে শুরু করে। এতে করে প্রায় ১০-১২জন শ্রমিক নিহত হয় । পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা লড়াইকে স্বীকৃতি দিয়ে ওই ঘটনার স্মারক হিসেবে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অবশেষে শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়। সেই থেকে পহেলা মে পালিত হয় হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস।

বিজ্ঞাপন

শ্রমিক দিবস কবে, কেন শ্রমিক দিবস পালিত হয় সে বিষয়ে কোনো কিছুই জানেনা তছিরন বেগম। তিনি বলেন, শ্রমিক দিবস কি এবং কেন পালিত হয় এ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।

তিনি আরও বলেন, কয়লা বোঝাই করা কাজ অনেকদিন ধরে করতেছি। আমাদেরকে খেটে খাওয়া লাগে। আমার একটা ছেলে সন্তান আছে। তার ঘরে দুটো মেয়ে আছে। আমার ছেলেও অসুস্থ। সে আগে মাছের ব্যবসা করতো। একদিনে আয় হয় দুই থেকে তিনশো টাকা। এই টাকা দিয়ে কিছুই হয়না। ৬০ বছর বয়সে এসে আমাদের এই কাজ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ঘরে ইনকাম করার মতো কেউ নেই। আমার কোনো বয়স্ক ভাতাও নেই।

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, আমি প্রায় ১২ ঘণ্টা কাজ করি। আমাগো মতো শ্রমিকদের জীবনের কোনও নিশ্চয়তা নাই। এখানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে মালিক পক্ষ কোনো ধরনের সাহায্য করে না।

হাফিজুর রহমান নামে আরেকজন কয়লা শ্রমিক বলেন, এখানে যে যতবেশি পরিশ্রম করে, সে ততবেশি টাকা পায়। কেউ কেউ ২০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত ইনকাম করে। অতিরিক্ত গরমের কারণে এখন কাজ করতে অনেক অসুবিধা হচ্ছে। যে টাকা ইনকাম করতেছি এটা দিয়ে পরিবার চলে না। মাঝে মাঝে ঋণ করে চলতে হয়। আমরা অসুস্থ হলে মালিক পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য আসে না।

মে দিবসের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি তছিরন বেগমের মতো একই কথা বলেন। তিনি বলেন, আমি শ্রমিক দিবসের নাম জীবনেও শুনি নাই।

সয়েলি আক্তার নামে একজন মহিলা বালু শ্রমিক বলেন, আমি দৈনিক ১২ ঘণ্টা কাজ করি। সারাদিন পরিশ্রম করে ২০০-৩০০ টাকা পাই। পরিবারে আমার স্বামী এবং একটা ছোট মেয়ে আছে। এই রোদের ভিতরে কাজ করে চেহারা খারাপ হয়ে গেছে। আমরা গরীব মানুষ, আমাদেরকে কাজ করেই খেতে হবে। শ্রমিক দিবস সম্পর্কে তিনি বলেন, পহেলা মে শ্রমিক দিবস একথা আমরা লোকমুখে শুনছি। কিন্তু, এ সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না।

নাম বলতে অনিচ্ছুক একজন বালু শ্রমিক বলেন, ৪৫ টা টুকলি টানলে ১০০ টাকা পায়। গরমের কারণে ১০০ টাকাও ইনকাম করতে কষ্ট হয়। পরিবারে ঠিকমতো বাজারের খরচই হয়না। আমি ছাড়া সংসারে ইনকাম করার মতো কেউ নেই। আমার এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি অনেক আগে। আমার স্বামী মারা গেছে অনেক আগে। অভাবের তাড়নায় ১৩ বছরের ছেলেকে গার্মেন্টসে দিয়েছি। বেতন পায় মাত্র ৫ হাজার। কোনোমতে ডালভাত খেয়ে বেঁচে আছি। আমার ছেলে আমার একমাত্র ভরসা। আমার ছেলের নাম মো. ইয়াসিন। এই কাজ করতে গিয়ে যদি আমার কোনও সমস্যা হয় তাহলে আল্লাহ ছাড়া দেখার কেউ নেই। আমি টাকার জন্য বাজার করতে পারি না। জিনিসপত্রের দামের তুলনায় আমাদের পারিশ্রমিক বাড়ছে না। আমাদের এখন তেমন ইনকাম হয় না।

শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি শ্রমিক দিবস সম্পর্কে অল্প একটু জানি। এদিনে বিদেশে শ্রমিকরা আন্দোলন করেছে।