আগে মানব পাচারকারীরা সীমান্ত পথ ব্যবহার করলেও বর্তমানে বেনাপোল রুটে বৈধ পথে তারা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গত এক মাসে এ পথে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানোর সময় সন্দেহজনক এমন ৭ জনের ভিসা বাতিল করে ফেরত পাঠিয়েছে ভারতের পেট্রাপোল ইমিগ্রেশন।
পাচার প্রতিরোধে ভারত অংশে ইমিগ্রেশনে বেশ কড়াকড়ি দেখা গেলেও বাংলাদেশ অংশে পাচারকারীরা ম্যানেজ করে অনায়াসে নিয়ে যাচ্ছে ওপারে। তবে বেনাপোল ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ বলছেন সন্দেহ হলে তারাও জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু ভারতীয় হাইকমিশন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেহেতু যাচাই-বাছাই করে ভ্রমণের অনুমতি দিচ্ছে তাই অনেক সময় আইনগত জটিলতায় সন্দেহ হলেও আটকানো সমস্যা হয়ে দাড়ায়।
পাচার প্রতিরোধ সংস্থ্যাগুলো বলছেন, পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য কমাতে ভিসা প্রদান সংস্থাগুলোর পাশাপাশি সীমান্তের ইমিগ্রেশনগুলোকে আরো সতর্কতা বাড়াতে হবে।
সুত্রগুলো জানায়, আগে মানবপাচারকারীরা অসহায়দের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশ নিতে সীমান্ত পথ ব্যবহার করতো। বর্তমানে সীমান্ত পথ অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ায় বৈধ পথ ব্যবহার করছে। এ ক্ষেত্রে গেল কয়েক বছর ধরে রুট হিসাবে বেশি ব্যবহার করছে বেনাপোল ইমিগ্রেশন আর ওপারের ভারতের পেট্রাপোল ইমিগ্রেশন। পরে ভারতে নিয়ে সেখান থেকে পাঠাচ্ছে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে।
গেল দেড় বছর ধরে করোনার মহামারীতে সরকারের নানা বিধি নিষেধে ট্যুরিস্ট ও বিজনেস ভিসা বন্ধ থাকায় পাচারকারী সিন্ডিকেট অনেকটা বেকায়দায় পড়লেও আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে বৈধ পথেই নিচ্ছে ভারতে। এক্ষেত্রে ভিসা ও ভ্রমণ অনুমতির সাথে জড়িত এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে মেডিকেল ভিসাও সংগ্রহ করছে। পরে তাদের পছন্দের রুট বেনাপোল দিয়ে পাঠাচ্ছে ভারতে। এ সীমান্তে পাচার কাজে তারা শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। অভিযোগ রয়েছে এসব সিন্ডিকেটের সদস্যদের সাথে দুই পারের ইমিগ্রেশনের রয়েছে গভীর সখ্যতা। কয়েক বছর আগে ভারতের পেট্রাপোল ইমিগ্রেশনের সামনে দূর্বৃত্তদের গুলিতে একজন নিহতের ঘটনা এবং চেকপোস্ট দিয়ে মানব পাচারের অভিযোগ কেন্দ্রে পৌঁছালে কড়াকড়ি আরোপ করে পেট্রাপোল ইমিগ্রেশন। এরপর থেকে পেট্রাপোল ইমিগ্রেশন এলাকায় অবৈধ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এখনও সে অবস্থা চলছে। ফলে মানবপাচারে সহযোগী সিন্ডিকেটের সদস্যরা সুবিধা করতে পারে না। তবে বাংলাদেশ অংশে বেনাপোল ইমিগ্রেশনে সাইন বোর্ডে সাধারণদের প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা লেখাসহ নানান সতর্কবানী থাকলেও হরহামাশায় সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিভিন্ন পরিচয়ে ঢোকে ইমিগ্রেশন ভবনে।
গত ২৮ জুলায় ভারতে তিন বছর জেল খেটে বেনাপোল ইমিগ্রেশন হয়ে ট্রাভেল পারমিটে দেশে ফেরে ১০ বাংলাদেশি। এদের মধ্যে ৪ জনকে মালায়েশিয়া পাঠাতে দালালরা ভারতে নিয়েছিল। পরে ব্যাঙ্গালোর বিমান বন্দরে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের হাতে আটক হয় বলে জানায় ফিরে আসা একজন ভুক্তভোগী শাকিল।
মানব পাচার প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা এনজিও সংস্থা রাইটস যশোর এর নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক জানান, পাচারের শিকার যাদেরকে উদ্ধারের পর ফেরত আনা হয়। এরা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে চাইলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন সহযোগিতা মেলে না। ফলে পাচারকারীরা পার পেয়ে যাওয়ায় দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে।
এনজিও সংস্থ্যা জাস্টিস এন্ড কেয়ারের যশোরের এরিয়া ম্যানেজার এবিএম মুহিত হোসেন জানান, ভারতে পাচারের শিকার হওয়া যে সকল নারী, পুরুষদের তারা ট্রাভেল পারমিটের মাধ্যমে ফেরত আনেন। এদের অনেকেই নেওয়া হয়েছিল বেনাপোল ইমিগ্রেশন হয়ে ভারতে। পাচারকারীরা ভারতে নেওয়ার আগে তাদের এমন ভাবে শিখিয়ে নেন তাদের শনাক্ত করা কঠিন।
পাচার প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা ব্র্যাকের সিনিয়র জেলা ব্যবস্থাপক আশরাফুল ইসলাম জানান, তাদের পরিসংখ্যান মতে প্রতিবছর সীমান্ত পথে ভারতে ৫০ হাজার নারী, শিশু ভালো কাজের প্রলোভনে পাচার হচ্ছে। যাদের বড় একটি অংশ যশোর সীমান্ত পথে ভারতে নেওয়া হয়। যে পরিমান পাচারের শিকার হয় তার মাত্র ৫ শতাংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়। পাচার প্রতিরোধ করতে গেলে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর আরো কঠিন ভূমিকা পালন করতে হবে।
বেনাপোল ইমিগ্রেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহসান হাবিব জানান, গত এক মাসে বেনাপোল ইমিগ্রেশন হয়ে ভারতে যাওয়ার পর ভারতীয় ইমিগ্রেশন সন্দেহভাজন ৭ জন বাংলাদেশিকে ঢুকতে না দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে। এরা মেডিকেল ভিসা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল। তাদের বিষয়ে আমরা ডায়েরী এন্টি করেছি। এরা ভারত ভ্রমণের বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে না পারাই তাদের ফেরত পাঠায়। জানতে পেরেছি এরা অনেকেই ভারত হয়ে বিদেশ যাওয়ার জন্য আসে।