জাতীয় সংসদের মূল নকশায় কোথাও মাজার বা কবরস্থানের উল্লেখ না থাকলেও রাজনৈতিক ইচ্ছায় গড়া হয় জিয়াউর রহমানের মাজার। একইভাবে আরো ৭ জনের কবরস্থান গড়া হয় সংসদ এলাকাতেই। কাজেই মূল নকশায় ফেরত যেতে হলে সিদ্ধান্তটি আসতে হবে রাজনৈতিক ভাবেই। সম্প্রতি ‘চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবরে জিয়া লাশ নেই’ বলে মন্তব্য করে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর সরকারি দলের মন্ত্রী, এমপিগণ কবর সরানো ও জিয়ার কবরে জিয়ার লাশ থাকা না থাকা নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। জিয়াউর রহমানের গড়া দল বিএনপি থেকেও পাল্টা চ্যালেঞ্জ জানানো হচ্ছে। তবে বাইরে আলোচনা যতটাই গরম ভেতরের পরিস্থিতি ততটাই শীতল।
সংসদের বাইরে বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য আসলেও সংসদ সচিবালয় বা সংসদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন। অনেকেই বলেছেন কবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত যেমন রাজনৈতিক ছিল, কবর সরানোর সিদ্ধান্তও আসতে হবে সর্বোচ্চ মহল থেকে। অর্থাৎ সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের কথিত মাজার থাকবে কি থাকবে না।
বিষয়টি নিয়ে সংসদ সচিবালয় বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে সবার উত্তরে একই সূর! বিষয়টি নিয়ে তারা কেউ কিছুই জানেন না বলে মন্তব্য করেছেন।
সংসদ এলাকায় জিয়াউর রহমানের কবরসহ অন্যান্য স্থাপনা সরানোর কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কিনা জানতে চাইলে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘না, আমার জানামতে এরকম কোন সিদ্ধান্ত নাই’।
নকশার আলোকে সবকিছু সাজানো হবে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কিনা? ‘আমি তো বললামই এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না’।
এর আগে বিষয়টি নিয়ে একবার আলোচনা উঠলে তখন সংসদ চত্বরে কবর থাকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়া বার্তা২৪.কম-কে বলেছিলেন, ‘সংসদ চত্বরের ভেতরে কারো মাজার বা কবর থাকতে পারে না। এসব কবর দ্রুত সরিয়ে ফেলা দরকার। যার যার জন্মস্থানে কবরগুলো সরিয়ে দিলেই কোন ঝামেলা থাকে না।’
বর্তমানে ডেপুটি স্পিকার চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে থাকায় নতুন করে বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর ই আলম চৌধুরী বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘সংসদে এ ব্যাপারে এখনো আলোচনা হয়নি। এটা মূলত আসবে পূর্ত বিভাগ হয়ে।’
সাম্প্রতিক আলোচনার পর জিয়াউর রহমানের কবরসহ নকশা বর্হিভুত অন্যান্য স্থাপনা সরিয়ে নেবার কোন আলোচনা বা পরিকল্পনা আছে কিনা? জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার নলেজে নাই। অন্যেরটা বলতে পারব না। এটা নিতে হলে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেবে। আমি সংসদ নিয়ে ব্যস্ত, এই সাবজেক্টে না। এটা সংসদ নেতা, স্পিকার ও মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত; আমি জানি না।’
জাতীয় সংসদের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ই/এম) মো. আবুল কালাম বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত আমার জানা নেই। নকশা নিয়ে কোন আলোচনাই হয়নি। তাছাড়া আমরা এই সংশ্লিষ্ট লোকও না। আমরা নতুন কোন প্রজেক্ট হলে সেটা বাস্তবায়ন করি আর সেটার প্লান ঠিক করে স্থাপত্য বিভাগ, আমরা শুধু প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করি। গণপূর্তের কাজ হচ্ছে মাস্টার প্লান বাস্তবায়ন করা।’
নকশা আনার ক্ষেত্রে সবার চাইতে বেশি ভূমিকা পালন করেছেন স্থাপত্য অধিদপ্তরের সাবেক স্থপতি প্রধান কাজী গোলাম নাসির। তিনি বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘আমি তো এখন দায়িত্বে নেই, কাজেই আমি সবশেষ তথ্য জানি না। আমাদের নির্দেশনা ছিল নকশা আনার, আমরা এনেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় স্পিকারকে সঙ্গে নিয়ে নকশা দেখেছেন। এখন কি করবেন, না করবেন সে বিষয়ে আমাদের কখনো কোন নির্দেশনা দেননি।’
জাতীয় সংসদের মূল নকশা আনার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যুক্ত ছিলেন জাতীয় সংসদের সাবেক অতিরিক্ত সচিব আ. ই. ম. গোলাম কিবরিয়া।
তিনি বার্তা২৪.কম-কে বলেন, নকশা আইনা রাখল, এরপর আর তেমন কিছু হয় নাই। আনার পর আমরা কেউ সরব থাকি নাই। স্পিকার মহোদয় বিজ্ঞ ব্যক্তি উনি ওটাকে সুন্দরভাবে ইয়ে করে রেখে দিয়েছেন। একেবারেই উপরের লেভেলে লোক আছেন মাননীয় সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া উনি (স্পিকার) অন্য কারো কথায় সিদ্ধান্ত নেন না। আমরাও নেই না। রাষ্ট্রের জিনিসটা আসছে আমরা ওটাইতে খুশি। এটার লক্ষ্য কি? কি করবে না, কি করবেন, কি করা যাবে, কি করা যাবে না এগুলো আমাদের লক্ষ্য ছিল না। আমাদের লক্ষ্য ছিল নকশা আনা।’
জিয়াউর রহমানের কবরসহ অন্যান্য স্থাপনা সরানো নিয়ে কি কখনো আলোচনা ছিল? এ বিষয়ে গোলাম কিবরিয়া বলেন, এ ব্যাপারে সংসদ নেতা ওইভাবে সরাসরি কিছু বলেন নাই। আর সরকার কি চাইছে সবকিছু আমাদের জানা নেই।’
সংসদ নেতা কি কখনো কবর সরানোর কোনো ইঙ্গিত দিয়েছিলেন প্রসঙ্গে সাবেক অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘না, না, কখনো এ ব্যাপারে লিখিত কোন রকমের আঁচও দেন নাই।”
স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থাপতি মীর মঞ্জুর রহমান বার্তা২৪.কম-কে বলেন, “আমি এখানে খুব বেশি দিন আসি নাই। আমি বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানি না।”
বিশ্বখ্যাত ফরাসি স্থপতি লুই আই কানের মূল নকশায় সংসদ ভবন এলাকায় কারো সমাধি গড়ার কোন সুযোগ না থাকলেও জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে এসব মাজার-কবর গড়ে ওঠে। এর মধ্যে সংসদ ভবনের উত্তরে ৭৪ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত চন্দ্রিমা উদ্যানের মাঝখানে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা হয় জিয়ার মাজার কমপ্লেক্স। আর জিয়া ও এরশাদের শাসনামল মিলিয়ে সংসদ ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মানিক মিয়া এভিনিউ এর পশ্চিম প্রান্ত লাগোয়া স্থানে পাঁচ বিঘারও বেশি জায়গাজুড়ে ‘জাতীয় কবরস্থান’ নাম দিয়ে আরো অন্তত সাতজনকে সমাধিস্থ করা হয়। এদের মধ্যে ১৯৭৯ সালে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ ও রাজনীতিক মসিউর রহমান যাদু মিয়া, ১৯৮০ সালে তমীজ উদ্দিন খান, ১৯৮২ সালে খান এ সবুর, এবং ১৯৯১ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খানকে কবর দেওয়া হয়। প্রত্যেকের কবরে তোলা হয় পাকা সমাধিসৌধ।
এছাড়া নাম-পরিচয়ের সাইনবোর্ডহীন আরো দু’টি কবর দেখা যায় এই ‘জাতীয় কবরস্থানে’। এর একটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজের। শাহ আজিজসহ এদের অধিকাংশের নামেই স্বাধীনতাযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা পালনের অভিযোগ রয়েছে।
কখন কিভাবে মূল নকশার আলোচনা শুরু:
এসব মাজার-কবর নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনা উঠে। মূল নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে এভাবে মাজার-কবর গড়ায় সংসদের সৌন্দর্য্য নষ্ট হয়। সংসদের নিরাপত্তা ও সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি লুই আই কান এর মূল নকশা সংগ্রহের নির্দেশ দেন সংসদ সচিবালয়কে।
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৪ সালে লুই আই কান যখন মূল নকশাটি করেন, তখন ২৭টি মন্ত্রণালয়ের জন্য এ পরিকল্পনা করেন। তখন সেখানে মসজিদ ছিল, মাঝে বাগান ছিল, চন্দ্রিমা উদ্যানের ওখানে একটি বড় সড়ক ছিল, এর সামনে লেক ছিল, এরপর সংসদ ভবন ছিল। তাই অনুলিপি ধরে নয়, ১৯৭৪ সালের মূল নকশা ধরে সচিবালয়সহ সব কিছু করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
১৯৭৪ সালে শেরেবাংলা নগরে ৪২ একর জায়গায় জাতীয় সচিবালয় নির্মাণের জন্য সরকার ও মার্কিন কোম্পানি ডেভিড উইসডম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সঙ্গে চুক্তি হয়। পরে এর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ওই এলাকায় এরই মধ্যে ১০ একর জমিতে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। জমি কমে যাওয়া এবং বর্তমানের চাহিদা বিবেচনায় লুই আই কানের নকশা স্থাপত্য অধিদপ্তর কিছুটা সংশোধন করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, লুই আই কানের মূল নকশার প্রথম ধাপ ছিল ২০৮ একর জায়গার ওপর জাতীয় সংসদ ভবন নির্মাণ। যার সামনে ও পেছনেও বিস্তীর্ণ সবুজ খোলা মাঠ থাকবে। চারদিকে আট লেনের সড়ক, মাঝখানেও লেক। দ্বিতীয় ধাপে লেকের পর বিস্তীর্ণ সবুজ। এছাড়া বাকি জায়গায় গড়ে তোলা হবে সচিবালয়, লাইব্রেরি, জাদুঘর, হাসপাতালসহ প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক বলয়।
লুই আই কানের নকশা ক্ষত-বিক্ষত করার প্রক্রিয়া এখানেই থেমে থাকেনি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। ওই সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। লুই আই কানের নকশা উপেক্ষা করে আসাদগেটের উল্টো দিকে অবস্থিত সংসদ ভবনের জায়গায় একটি পেট্রলপাম্প স্থাপনের জন্য তিনি তার ছোট ভাই মির্জা খোকনকে জায়গা বরাদ্দ দেন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মাঝামাঝি সময়ে আরও এক দফা ক্ষত-বিক্ষত করা হয় লুই আই কানের মূল নকশা। ওই সময় সংসদ ভবনের মূল ভবনের পাশেই খোলা সবুজ চত্বরে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন নির্মাণ করা হয়।
জাতীয় সংসদের ইতিকথা:
১৯৬১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের আমলে বর্তমান সংসদ ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সে সময় স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে এই ভবনের স্থপতি নিয়োগ করা হয়। তার প্রস্তাবেই লুই আই কান এই প্রকল্পের প্রধান স্থপতি হিসেবে নিয়োগ পান। দীর্ঘ সাধনার পর ১৯৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি এ ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়।