পাহাড়, ঝরনা আর সবুজের প্রাচুর্যে ভরপুর সিলেটের গোয়াইনঘাট। ভারতের সীমান্তবর্তী এ উপজেলাতেই রয়েছে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু সিলেটের জাফলং জিরো পয়েন্ট, পাথরের নদীখ্যাত বিছনাকান্দি এবং মিঠাপানির একমাত্র জলাবন রাতারগুল। এসব পর্যটনকেন্দ্রের বৈচিত্র্যে ভরা সৌন্দর্য দেখতে ছুটে আসেন পর্যটক আর ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। কিন্তু এখানে পর্যটকদের জন্য বাড়ানো হয়নি সুযোগ-সুবিধা। এসব স্থানে শৌচাগার, কাপড় পাল্টানোর সুবিধা ও বিশ্রামাগার না থাকায় পর্যটকেরা বিপাকে পড়ছেন। তবে শিগগিরই এসব পর্যটনকেন্দ্র পর্যটকবান্ধব হওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসন। তারা বলছেন, এতদিন জমি ও ফান্ড সংক্রান্ত জটিলতা থাকায় সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো সম্ভব হয়নি।
করোনাকালীন দীর্ঘ দুই বছর বন্ধ ছিল পর্যটনস্পট। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর গত মাস থেকে খুলে দেয়া হয়েছে পর্যটন স্পটগুলো। এখন লোকে লোকারণ্য এসব এলাকা। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের পর্যটকরা ছুটে আসছেন। বিশেষ করে শুক্র ও শনিবার পর্যটকদের পদভারে মুখরিত থাকে সিলেটের এই গোয়াইনঘাট।
মানিকগঞ্জ থেকে আসা পর্যটক অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম জসিম বার্তা২৪.কমকে বলেন, পিয়ানের বুকে সাঁতার কাটবো বলে জাফলং আসলাম। দশ টাকা করে টিকিট কেটে প্রবেশ করে কোনো টয়লেট খুঁজে পেলাম না। নেই কোনো বিশ্রামাগারও। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পাথরের উপরেই বিশ্রাম নিতে হয়েছে।
তিনি রাতারগুল ও বিছানাকান্দি পর্যটন এলাকায় একই অবস্থার কথা জানান। অ্যাডভোকেট জসিম বলেন, রাতারগুল ও বিছানাকান্দি স্পটে যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই খারাপ। এসব জায়গায় নৌকায় উঠার জন্য কোনো ঘাটের ব্যবস্থা নাই, ঘাট না থাকার কারণে সামান্য বৃষ্টিতে এঁটেল মাটি খুব পিছলা হয়ে যায় এবং পর্যটকরা মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
সাম্প্রতিক সময়ে জাফলং ও রাতারগুলে পর্যটকদের জন্য টিকিট ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে জাফলংয়ে জনপ্রতি দশ টাকা আর রাতারগুলে ৫০ টাকা করে গ্রহণ করা হলেও পর্যটন স্পটে বেড়াতে আসা লোকজন পাচ্ছেন না সুবিধা। এ নিয়ে নতুন করে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।
সাভার থেকে আসা পর্যটক সাইফুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, দশ বছর আগে এসে দেখেছি টয়লেট ছিলো না। এখনও নেই। তাহলে এখন টিকিটের ব্যবস্থা করার মানে কি? গাছের নিচে কিংবা পাশে পর্যটকদের মধ্যে প্রশ্রাব করা কতটা সমীচীন?
তিনিও রাতারগুল ও বিছানাকান্দিতে শৌচাগার না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সাইফুল বলেন, রাতারগুল ও বিছানাকান্দিতেও গিয়েছি। সেখানেও বাথরুমের কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। আর রাস্তা-ঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। হালকা বৃষ্টিতে রাতারগুলের অবস্থা বেহাল হয়ে যায় পর্যটকদের কাদা মাড়িয়েই নৌকায় উঠতে হয়।
জাফলংয়ে ইউনিয়ন পরিষদের নির্মিত একটি গণ-শৌচাগার থাকলেও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে পর্যটকরা ব্যবহার করতে পারেন না। গোয়াইনঘাটের আরেকটি পর্যটনস্পট রাতারগুল। সেখানে গণ সৌচাগার থাকলেও সেটিও নিম্নমানের। নারী ও শিশু পর্যটকদের জন্য নেই বিশ্রামাগার কিংবা কাপড় পাল্টানোর সুবিধাও। বেসরকারি উদ্যোগে স্পট এলাকায় অস্থায়ী কিছু সুবিধা গড়ে তোলা হলেও নিরাপত্তার জন্য পর্যটকরা সেটি ব্যবহার করতে পারেন না।
বিছানাকান্দি টুরিজম ক্লাবের সেক্রেটারি ইসমাইল হোসেন শিমুল বার্তা২৪.কমকে বলেন, শুক্র ও শনিবার অনেক পর্যটক জাফলং, রাতারগুল ও বিছানাকান্দিতে বেড়াতে আসেন। কিন্তু বেড়াতে এসে বিশেষ করে নারী পর্যটকরা বেকায়দায় পড়েন। শৌচাগার ও কাপড় পরিবর্তনের কোনো অবকাঠামোগত সুবিধা এখানে গড়ে তোলা হয়নি। এতে পর্যটকদের বিপদে পড়তে হচ্ছে। সেটা খুবই দুঃখজনক।
সিলেট শহরের আম্বরখানা থেকে জাফলং-রাতারগুল ও বিছানাকান্দি রুটে ১৩ বছর ধরে অটোরিকশা চালান গোয়াইনঘাটের নোয়াগাঁও গ্রামের মঞ্জুর আহমেদ। বার্তা২৪.কমকে তিনি জানান, শুক্রবার ও শনিবার জাফলং-রাতারগুল ও বিছানাকান্দি স্পটে পর্যটকরা বেশি আসেন। এদের অধিকাংশই সিএনজি অটোরিকশায় এসব এলাকায় যাতায়াত করেন। পর্যটকদের অধিকাংশও স্পট থেকে ফেরার পথে রাস্তায় সিএনজি থামিয়ে প্রশ্রাব-পায়খানা করে থাকেন।
মঞ্জুর বলেন, স্পটে যদি বাথরুমের ব্যবস্থা থাকতো তাহলে পর্যটকদের অনেক সুবিধা হতো। এভাবে রাস্তা-ঘাটে দাঁড়িয়ে প্রশ্রাব করা দেখতেও খারাপ দেখা যায়।
বিছানাকান্দি ও রাতারগুলের যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত। সড়কগুলো বেহাল। খানাখন্দে ভরপুর। সংস্কারের ছোঁয়া না পেয়ে কোথাও সড়ক হয়ে উঠেছে চাষের জমি, আবার কোথাও যেন মাছের খামার। রাস্তা ভালো না হওয়ায় এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বিছানাকান্দির পর্যটন বিকাশের সম্ভাবনায়।
ঢাকা থেকে আসা পর্যটক ব্যাংকার মইনুল হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, বিছানাকান্দিতে যাওয়ার রাস্তাটা একেবারেই খারাপ। বৃষ্টিতে হয়ে উঠে আরও ভয়ঙ্কর। রাস্তা থেকে নৌকায় উঠতে হাটতে হয় অনেকখানি পথ। কাদায় একাকার হতে হয়। দেখে মনে হচ্ছে এদিকে কারো নজরই নেই।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিলুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমাদের তিনটা স্পট আসলে তিন ধরনের। এসব স্থানে স্থাপনা করতে আমাদের কিছুটা পারমিশন লাগে। তারপরও আমরা স্থাপনা করছি। জাফলংয়ে আমরা সম্প্রতি দশ টাকা করে টিকিট চালু করেছি। ফান্ড সংক্রান্ত কিছু জটিলতা ছিল। আমাদের এই ফান্ড থেকে আমরা এক মাসের মধ্যে ওয়াশরুম এবং ড্রেস চেঞ্জ সুবিধাগুলো ডেভেলপ করে ফেলবো। জাফলং খুব দ্রুতই সাফিসিয়ান্ট হয়ে যাবে ফ্যাসিলিটিজের দিক থেকে।
বিছানাকান্দি স্পট প্রসঙ্গে তাহমিলুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, বিছানাকান্দি যে স্পট সেটি ঠিক বর্ডারের অংশটুকুই সরকারের জায়গা। আর বাকি যে জায়গা আছে সেটি ব্যক্তিগত জায়গা। এখানে ল্যান্ড সংক্রান্ত জটিলতা থাকাতে আমরা এখানে স্থাপনা করতে পারি না প্রায়শই। আমাদের সম্প্রতি একটা বড় প্রজেক্ট এখান থেকে ভোলাগঞ্জে শিফট করতে হয়েছে শুধু ল্যান্ড সংক্রান্ত জটিলতার কারণেই। বিছানাকান্দিতে একটা ভাসমান রেস্টুরেন্ট আছে সেটা দিয়েই মোটামুটি কাজ চালাচ্ছি।
রাতারগুল স্পট প্রসঙ্গে ইউএনও তাহমিলুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, রাতালগুলের বিষয়টা ভিন্ন। রাতালগুলের টোটাল ল্যান্ডের মালিক হচ্ছে বনবিভাগ। বনবিভাগের জায়গার ভেতরে আমরা কিছু করতে পারি না, আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। তবে তারা বলছে তারা কিছু ফ্যাসালিটিজ ডেভেলপ করছে। একটা ঘাটে কিছু প্রাইভেটলি কিছু ডেভেলপমেন্ট হলেও বাকি ঘাটগুলোতে হয়নি।
তিনি বলেন, তবে একটা বন সহ-ব্যবস্থাপনা নির্বাহী কমিটি আছে। বনবিভাগ সম্প্রতি ৫০ টাকা করে প্রত্যেক পর্যটকদের কাছ থেকে নিচ্ছে আর নৌকা প্রতি ১০০ টাকা করে নিচ্ছে। এর সাথে ভ্যাট যোগ হবে। এই ফান্ডের ফিফটি পার্সেন্ট বন ফ্যাসালিটিজ পারপাস ব্যবহৃত হয়। আমি সম্প্রতি বন বিভাগকে চিঠি লিখেছি, আপনারা টাকাটা ব্যবহার করেন। পর্যটকদের ফ্যাসালিটিজ ডেভেলপ করেন। তারাও প্রসেসে আছে। কিন্তু এটা তাদের মাধ্যমে হতে হয়।