দৃশ্যমান হচ্ছে বঙ্গবন্ধু টানেল, পদ্মা সেতুর পরেই চালুর আশা

, জাতীয়

মানসুরা চামেলী, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 10:46:58

চট্টগ্রাম থেকে: কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ প্রকল্পের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) দিয়ে সুড়ঙ্গ (টিউব) তৈরির কাজ। তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল টানেলের ২ দশমিক ৪৫ কিমি দীর্ঘ প্রথম সুড়ঙ্গের কাজ শেষ হয়েছে গত বছরেই।

নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়েছে টানেলের দ্বিতীয় সুড়ঙ্গের খননকাজও। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের আনোয়ারা প্রান্ত থেকে পতেঙ্গা প্রান্তের ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার দ্বিতীয় সুড়ঙ্গের এ কাজ সম্পন্ন হয়। বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রায় ৭৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ মূল টানেলের কাজ শেষ।

বাকি শুধু দুই সুড়ঙ্গের বাইরে দুই প্রান্তের অ্যাপ্রোচ রোড তৈরি, সেই কাজও চলছে দিন রাত। সেই সঙ্গে সমানতালে চলছে প্রথম সুড়ঙ্গের স্লাব ঢালাই ও বৈদ্যুতিক সংযোগের কাজ। জানুয়ারিতে শুরু হবে দুই সুড়ঙ্গের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের কাজ। নির্ধারিত মেয়াদ বা তার আগেই প্রকল্পের কাজ শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

দুই সুড়ঙ্গ তৈরির মধ্য দিয়ে কর্ণফুলী টানেল এখন অনেকটা দৃশ্যমান।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, দুই সুড়ঙ্গ তৈরির মধ্য দিয়ে কর্ণফুলী টানেল এখন অনেকটা দৃশ্যমান। চট্টগ্রামবাসীর স্বপ্ন পূরণ হতে আর বেশিদিন নেই। দেশের আরেকটি মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু চালুর করা পর এই কর্ণফুলি টানেল চালু করা হতে পারে। ২০২২ সাল দেশবাসির জন্য বিশাল মাইলফলক নিয়ে আসবে। দেশের দুই বৃহৎ প্রকল্প ওই বছরে চালু হতে যাচ্ছে।

তারা জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এরই মধ্যে কাজের গতি বাড়ানোর জন্য বাড়তি জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। একই সঙ্গে কাজ এগিয়ে নিতে অত্যাধুনিক নানা যন্ত্রপাতি, মেশিনারিজ সংযুক্ত করা হয়েছে। ফলে কাজের গতি অনেকটাই বেড়েছে।

চট্টগ্রামবাসীর স্বপ্ন পূরণ হতে আর বেশিদিন নেই।

প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. হারুনুর রশিদ চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, আপনারা জানেন, যেকোন কাজের প্রথমদিকে বেশি বেগ পেতে হয়। আর টানেল নির্মাণের আমরা একবারে নতুন এজন্য প্রথম সুড়ঙ্গে ১৭ মাস সময় লেগেছিল। এবার ১০ মাসে দ্বিতীয় সুড়ঙ্গ হয়ে গেলো। করোনাভাইরাস না হলে আরো দুই মাস হয়ত কম লাগত।

টানেল নির্মাণের চ্যালেঞ্জিং সময় পেরিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রকল্পের চ্যালেঞ্জিংয়ের মধ্যে এখন শুধু আছে ক্রস ফেসিস টু করা। বাকি কোন চ্যালেঞ্জ আর নেই। ল্যান্ডের সমস্যা ছিল সেটা সমাধান হয়ে গেছে। সুড়ঙ্গ পরিষ্কার আর দুই সুড়ঙ্গের মধ্যে ল্যান্ড স্লাব অর্থাৎ যার মধ্য দিয়ে গাড়ি চলবে আমরা সেই কাজগুলো করছি। প্রতিদিন প্রায় ৮০০/১০০০ শ্রমিক এখানে দিন রাত কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের জন্য টানেল যুগে প্রবেশ করা অভূতপূর্ব সাফল্য।

কর্ণফুলি টানেল নির্মাণ প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল চীনের সাংহাইয়ের ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ প্রকল্পের আদলে কর্ণফুলি নদীর দুপাশে বাণিজ্যিক হাব তৈরি করার। টানেল দিয়ে যান চলাচল শুরু হলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী যানবাহনকে আর চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করতে হবে না। সিটি আউটার রিং রোড হয়ে টানেলের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। এতে চট্টগ্রাম শহরে যানবাহনের চাপ কমে যাবে।

প্রকল্প পরিচালক বলেন, বাংলাদেশের জন্য টানেল যুগে প্রবেশ করা অভূতপূর্ব সাফল্য। বঙ্গবন্ধু টানেলের মাধ্যমে ভবিষ্যতে বন্দরনগরীর ব্যবসার আরও প্রসার ঘটবে। চীন ও কোরিয়া বেশি বেশি বিনেয়োগে আগ্রহী হবেন। জিডিপি বৃদ্ধিতে অবদান রাখার পাশাপাশি আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বন্দরথানার বাসিন্দা রবিউল বার্তা২৪.কমকে বলেন, কল্পনার করতে পারি নাই। নদীর তলদেশে এই কাজ করা হবে। বন্দর থানা ও আনোয়ারা থানা মধ্যে সংযোগ হবে। যাতায়তের জন্য খুব ভালো হবে। অল্প সময়ে আমরা কক্সবাজারেও যেতে পারব। এখানকার অর্থনৈতিক উন্নতিও হবে। আমাদের সময় বাঁচবে।

প্রকল্প প্রসঙ্গ

বঙ্গবন্ধু টানেলের খননকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর চুক্তি সই হয় ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর। এর আগে ২০১৪ সালে প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ও চীনের সরকারি পর্যায়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়। আর চীন সরকার এ টানেল নির্মাণের জন্য মনোনীত করে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) লিমিটেডকে। নকশা ও অন্যান্য কাজ শেষে ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি টানেলের নির্মাণকাজ শুরু হয়। উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

টানেল নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে চীন দিচ্ছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম টানেলের নামকরণ করা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে।

প্রকল্প সূত্র জানায়, মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। দুই সুড়ঙ্গে দুটি করে মোট চারটি লেন থাকবে। মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক থাকবে। আর আনোয়ারা প্রান্তে রয়েছে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ ওভারব্রিজ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর