নির্মাণের পরপরেই ভেঙে যায় সেতু, ভরসা ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকো

, জাতীয়

কল্লোর রায়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কুড়িগ্রাম | 2023-08-31 00:31:51

কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা ইউনিয়নের চর পাত্রখাতা সাব-বাধ এলাকায় থাকা একটি সেতু নির্মাণের দুই মাস পরেই বন্যায় ভেঙে গিয়ে কুড়িগ্রাম জেলা সহ গাইবান্ধা জেলার সতেরটি গ্রামের মানুষজনের যোগাযোগ ব্যবস্থার মারাত্মক অবনতি হয়েছে। নির্মাণকৃত সেতুটি ভেঙে পড়ায় এলাকাবাসী নিজেদের উদ্যোগে একটি সাঁকো তৈরি করে চলাচল করছে। তবে এই নড়বড়ে সাঁকো দিয়ে পারাপার হতে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন স্থানীয়রাসহ পথচারীরা।

সেতু সংলগ্ন বসত বাড়ির বাসিন্দা হাফিজুর রহমান জানান, এই এলাকায় আমাদেরকে সব সময় দূর্যোগের সাথে মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হয়। আমার বাড়ি সংলগ্ন এই ভাঙা সেতুর সাথে ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকোটি দিয়ে পার সময় আমার ছোট্ট ভাতিজি পানিতে পরে গিয়ে মৃত্যু হয়। কিছুদিন আগে স্থানীয় এক ব্যক্তি দোকান ঘর নির্মাণের জন্য ইট নিয়ে এই সাঁকোটি পার হওয়ার সময় নিচে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে যাওয়ায় সাতটি সেলাই পড়ে।


স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবুর রহমান জানান, গত ৭-৮ দিন আগে এই সাঁকোটি দিয়ে পারাপারের সময় হঠাৎ ভেঙে গিয়ে নিচে পড়ে যাই। নিচে থাকা ইটে পড়লে মাথায় আঘাত পেয়ে মাথা ফেটে যায়। পরে মেডিকেলে গেলে মাথার ক্ষত স্থানে ছয়টি সেলাই পড়ে।

সেতু সংলগ্ন অপর এক বাসিন্দা আব্দুল কুদ্দুস জানান, এই এলাকার রজ দেওয়ানী নামের এক ব্যক্তি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে মেডিকেল নিয়ে যাওয়ার পথে এই ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকো পার হওয়ার আগেই স্ট্রোক করে তার মৃত্যু হয়।

সেতু সংলগ্ন আরেক বসত বাড়ির বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, এখানে যে সাঁকোটি দাঁড়িয়ে আছে এটি আমরা তিন বছর আগে স্থানীয়রা তৈরি করে প্রতি বছর সংস্কার করে চলাচল করে আসছি। এটি তৈরীতে উপজেলা প্রশাসন কিংবা সরকারি কোন আর্থিক সহযোগিতা আমরা পাইনি।


তিনি বলেন, গত তিন মাস আগে স্থানীয় বাসিন্দা এরশাদুলের সন্তান আব্দুল কুদ্দুস সাঁকোটি থেকে পড়ে গিয়ে জখম হন। এছাড়াও কয়েকদিন আগে স্থানীয় বাসিন্দা আফসারের বাচ্চা এবং সাদ্দামের মেয়ে সাঁকো থেকে পড়ে আহত হয়। এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের সম্মানী ব্যক্তি বৃদ্ধ হজরত ব্যাপারী সাঁকোটি পারাপারের সময় নিচে পড়ে গিয়ে গুরুতর জখম হন। পরে তিনি চিকিৎসা বাবদ ১০-১৫ হাজার টাকা খরচ করেন।

তিনি দাবি করে বলেন, এখানে যদি একটি রাস্তা তৈরি হয় তাহলে এ এলাকার বাসিন্দারা নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবে। রক্ষা হবে এলাকার ফসলি জমির। আমার সন্তানরা নিরাপদে চলাচল করতে পারবে। গত তিন বছর আগে আমার এক ভাতিজি সাঁকো থেকে পানির স্রোতে পড়ে গিয়ে মারা যায়। যদি এখানে রাস্তা নির্মাণ না করা হয় তাহলে পানির স্রোতে এ এলাকার ৫-৭ টি বাড়ি ভাঙনে বিলীন হবে।

অন্যদিকে সেতুটি ভেঙে পড়ে থাকায় সাঁকো দিয়ে পার হয়ে ওই এলাকার পাত্র খাতা কমিউনিটি ক্লিনিকে যেতে দুর্ভোগে পড়ছেন স্থানীয় রোগীরা। এছাড়াও ইউনিয়নের ডাংরার চর সাব বাধ প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাত্র খাতা রিয়াজুল জান্নাহ দাখিল মাদরাসা, পাত্রখাতা তালিমুল কোরআন নূরানী মাদরাসা, চর পাত্রখাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ পূর্ব পাত্রখাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্রছাত্রীদের সাঁকোটি দিয়ে পারাপারের সময় নানা রকম ভোগান্তি সহ দুর্ভোগ পোহাতে হয়।


দুর্ভোগ নিয়ে চলাচলকারী পাত্র খাতা রিয়াজুল জান্নাহ দাখিল মাদরাসার সিনিয়র সহকারী মৌলভী রফিকুল ইসলাম জানান, 'এই সড়কটি হলো হরিপুর খেয়াঘাট থেকে প্রধান সড়ক। এই সেতুটির দক্ষিণে রয়েছে চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অধিকাংশ গুলিই প্রাথমিক বিদ্যালয়। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অধিকাংশ শিক্ষকরাই ভোগান্তি নিয়ে এই সেতুটি পারাপার হয়ে নিজ নিজ কর্মস্থলে যান। হরিপুর খেয়াঘাট থেকে আসা কাশিম বাজার গামী যাত্রীরা অত্যন্ত ভোগান্তি নিয়ে এই সেতুতে চলাচল করেন। এই এলাকার মানুষের যোগাযোগের জন্য এই সেতুটি প্রয়োজন। যত দ্রুত সম্ভব এই ভেঙে পড়ে থাকা সেতুটির সুরাহা করা হলে এই অঞ্চলের মানুষজন উপকৃত হবেন।

অপরদিকে সেতুটি ভেঙে পড়ে থাকায় ঝূঁকিপূর্ণ সাঁকো দিয়ে কোন যানবাহন চলাচল করতে না পারায় নানা রকম ভোগান্তি নিয়ে শহর থেকে কাঁচামাল আনতে হচ্ছে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের। এতে করে তারা ভিন্ন পথ দিয়ে কাঁচামাল আনায় পরিবহন খরচ বেশী পড়ায় তা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে বিপাকে পড়ছেন। এবং কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল পরিবহন করতে না পারায় তা বাহিরে বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে তারা ফসল উৎপাদন করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

জানা গেছে, উপজেলার রমনা ইউনিয়নের  পাত্রখাতা ব্যাপারী পাড়া সাব বাধ এলাকায় সাইদ আলীর বাড়ির পূর্বপাশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সেতু/ কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩০ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে ৪০ ফিট সেতুটি নির্মাণ করা হয়। নির্মাণের দুই মাস অতিবাহিত হলে বন্যার কবলে পড়ে ভেঙে যায় সেতুটি সহ সংযোগ সড়কের আনুমানিক চল্লিশ ফিট পর্যন্ত। পরে এলাকাবাসী স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের সামান্য আর্থিক সহযোগিতা পেয়ে নিজেরাই সেতু লাগোয়া কাঠ ও বাশ দিয়ে তৈরি করেন সাঁকো। পরে তিন বছর ধরে সেতুটি ভেঙে পড়ে থাকায় দুর্ভোগ ও ভোগান্তিতে পড়া স্থানীয়রা নিজেদের প্রচেষ্টায় সাঁকোটি পুনঃসংস্কার করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছেন তারা।

এ ব্যাপারে রমনা মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজগার আলী সরকার বলেন, কুড়িগ্রাম জেলার মধ্যে চিলমারী উপজেলা একটি বন্যা প্রবন এলাকা। গত ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে পাত্রখাতা সাব বাধ এলাকায় দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের অধীনে সেখানে একটি সেতু নির্মিত হয়। পরবর্তীতে একটি বন্যায় সেতুটি ভেঙে গিয়ে অচল হয়ে পড়ে। বিষয়টি আমি উপজেলার মাসিক মিটিংয়ে একাধিকবার উপস্থাপন করে কোন কাজ না হওয়ায় আমি নিজ অর্থায়নে একটি সাঁকো নির্মাণ করি। সেটিও স্থায়ী হওয়ার মতো নয়। স্থানীয়রা সেতুর পরিবর্তে সেখানে মাটি ভরাট করে রাস্তার নির্মাণের জন্য আবেদন দিয়েছে। বিষয়টি উপজেলার মাসিক মিটিংয়ে উপস্থাপন করেছি।

ভেঙে পড়ে থাকা সেতুটি নিয়ে পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. কোহিনুর রহমান জানান, 'জাইকা থেকে একটি প্রকল্প দেবে। সে প্রস্তাবটি আমরা প্রেরণ করব। প্রস্তাবটিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স্যারের স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছি। হয়তোবা দু-একদিনের মধ্যে আমরা প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেব'।

স্থানীয়দের রাস্তা চাওয়ার বিষয়টি অবগত করিয়ে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে, তিনি বলেন, 'স্থানীয়দের চাওয়ার বিষয়টি আমাদের মাথায় রয়েছে। প্রকল্পটি পেলে সেখানে একটি রাস্তা এবং পানি নিষ্কাশনের জন্য একটি সেতুও নির্মাণ করা হবে'।

এ সম্পর্কিত আরও খবর