১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর, সারাদিন ছিল গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয় হালকা বাতাস। রাত একটার দিকে ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়। হঠাৎ সমুদ্রের পানি সমতল থেকে ৮-১০ ফুট উচ্চতায় ওঠে আসে। এমন প্রলয়ংকারী জলোচ্ছ্বাস আর ঘূর্ণিঝড়ে লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগরের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ মারা যায়।
ঐ দিনের প্রত্যক্ষদর্শী আমির হোসেন। সেদিনের বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘বিসুধবারিয়া (বৃহস্পতিবার) দিন আছিল। গোটা দিন ঝড়ি (বৃষ্টি) ছিল। হাঁঝের তন (সন্ধ্যা থেকে) ধরি বাতাইস শুরু অয়ছে। রাইত একটার দিকে তুফান শুরু অয়। আচমকা মাথার ওপর হানি (পানি) উডি (উঠে) গেছে।’
‘হানিত (পানিতে) ডুবি আঁর দু’বোইন মরি গেছে। রাত তিনটার সময় হানির স্রোতে হেগুনের (তাদের) লাশ ভাসি গেছে। গাছপালার কারণে ঝাঁপ দি হেগুনরে (তাদেরকে) ধইরতে হারি ন। চাইর দিন হরে (পরে) নদীর কাছে এক বোন সাফিয়ার লাশ হায়। কিন্তুক রাবিয়াকে হায়নো (পায়নি)। হে সময় (তখন) সাফিয়ার বয়স আছিল ১২ আর রাবিয়া সাত বছরের।’
এদিকে ঐ ঘটনার দীর্ঘ ৪৮ বছর পরও রাবিয়ার মরদেহ খুঁজে পাওয়ার আশায় আছেন আমির হোসেন। আমির হোসেন লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগর উপজেলার মতিরহাট এলাকার বাসিন্দা। তিনি এখন ৬০ বছরে পা দিয়েছেন। কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। দীর্ঘ ৪৮ বছরেও তিনি ঐ প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ‘ভোলা সাইক্লোন’র কথা ভুলেননি।
স্বজনহারা উপকূলের মানুষগুলোর মনে এখনো দুঃস্বপ্ন হয়ে ভেসে উঠে দিনটি। সেদিনের স্মৃতিগুলো মনে করে এখনো আমির হোসেনের চোখ থেকে পানি ঝরে। ছোট বোন রাবিয়াকে না পাওয়ার বেদনা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
জানতে চাইলে আমির আরো জানান, তুফানের পর মাথার ওপর দিয়ে পানি আসছে দেখে মা-বাবা, দুই বোন ও দুই ভাইসহ তিনি ঘরের চালের ওপর উঠে যান। কিন্তু পানির ঢেউয়ের সঙ্গে তার দুই বোন পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
স্রোত এতো টান ছিল যে গাছপালার মধ্য দিয়ে তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পরের দিন আশপাশের অনেক স্থানে সাফিয়া ও রাবিয়াকে খুঁজেও পাননি। চারদিন পর বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে সাফিয়ার লাশ পাওয়া গেলেও রাবিয়াকে পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ংকারী ঐ ঘূর্ণিঝড়কে ২০১৭ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের আবহাওয়া সংস্থা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় বলে ঘোষণা করে। সরকারি হিসেবে ঐ দিন প্রাণ হারান প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। আর বেসরকারি তথ্যমতে এ সংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষ।
ঐ দিন নিহত মানুষদের স্মরণ, ঘূর্ণিঝড়ে সচেতনতা, উপকূলের সমস্যা, উপকূল সুরক্ষার জন্য দিনটিকে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছে ‘উপকূল দিবস বাস্তবায়ন কমিটি’। সংগঠনটির উদ্যোগে গত বছর উপকূলের ৩৪টি স্থানে একযোগে দিবসটি পালন করা হয়। এবার তা পালন হবে উপকূলের ৫৪টি স্থানে। ১২ নভেম্বর উপকূল দিবসের দাবিতে লক্ষ্মীপুরের তোরাবগঞ্জ, রামগতি ও রায়পুরে আলোচনা সভারও আয়োজন করা হয়েছে।