বনের জায়গায় ‘বিশাল সাম্রাজ্য’ বাদশার

  • জাহিদ রাকিব, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪ কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় একরের পর একর ‘বনের জায়গা’ দখল করে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন বাদশা গ্রুপ। সামান্য জায়গায় কিনে পাশে থাকা শত কোটি টাকা মূল্যের বনের জমি দখল করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে গ্রুপটির বিরুদ্ধে। দখলকৃত জমি উদ্ধারে বন বিভাগ একাধিক মামলা দায়ের করলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। দায়সারা গোছের এসব মামলা যোগসাজশে থেকেছে আলোচনার বাইরে। বারবার উচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হলেও এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে বাদশা গ্রুপের এ সাম্রাজ্য ।

বনের জমি খেকো বাদশা গ্রুপের মালিক বাদশা মিয়া। ১৯৭৬ সালের দিকে জীবিকার তাগিদে মাদারীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জে এসে সুতার ব্যবসা শুরু করেন। একপর্যায়ে সুতার গদির মালিক হন বাদশা মিয়া। সুতার ব্যবসা শুরু করলেও প্রথমে স্থাপন করেন তৈরি পোশাক কারখানা। ২০০০ সালে গড়ে তোলেন পাইওনিয়ার সোয়েটার লিমিটেড। এরপর ২০০৪ সালে ময়মনসিংহের ভালুকায় একে একে স্থাপন করেন বাদশা টেক্সটাইল লিমিটেড এবং কামাল ইয়ার্ন লিমিটেড।

বিজ্ঞাপন

বাদশা মিয়া তার বাহাদুরিতে বনের একরের পর একর জমি দখল করে গাছ কেটে নির্মাণ করেছেন বড় বড় কারখানা। প্রকৃতিকে বিপর্যস্ত করে হয়েছেন আর্থিকভাবে বিত্তবান। নিজে বিত্তবান হলেও ব্যাপক ক্ষতি করেছেন বনায়নের।

বন কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, লোকবলের সংকট, পুলিশি সহায়তা না পাওয়া, মামলা জটিলতা ও নিয়মের বেড়াজালে উদ্ধার করা যাচ্ছে না বনের সরকারি জায়গা। ফলে দিন দিন বনের জায়গার বেদখল হয়ে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

ভালুকায় বাদশার সাম্রাজ্যে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশেই বনের শত শত একক জায়গা দখল করে গড়ে তুলেছেন বাদশা গ্রুপের বিশাল কারখানা। যন্ত্রচালিত রিকশাতে করেও একপাশ থেকে অন্যপাশে যেতে লম্বা সময় কেটে যায়। মহাসড়কের একপাশে বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানা। ওপর পাশে অবস্থিত পাইওনিয়ার সোয়েটার লিমিটেডের কারখানা। বাইরে থেকে দৃশ্যমান বিশাল এসব স্থাপনা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ব্যক্তিগত প্রভাব এবং অসাধু বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নিজের জমির সঙ্গে থাকা বনের জমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে এসব কারখানা।

এলাকাবাসীর সূত্রে জানা যায়, ভালুকা উপজেলায় হাইওয়ে সড়কের পাশে ২০০৪ সালে একে একে স্থাপন করেন বাদশা টেক্সটাইল লিমিটেড এবং কামাল ইয়ার্ন লিমিটেড। সোনার চেয়েও মূল্যবান শত শত কোটি টাকার মূল্যের জমি দখল করে সীমানা প্রাচীর তুলে জমি দখল করে তারা। পরে পরিস্থিতি বুঝে বহুতল ভবন নির্মাণ করেন বাদশা মিয়া।

বন বিভাগের মামলা সূত্রে জানা যায়, ভালুকা উপজেলাধীন ভালুকা রেঞ্জের হবিবাড়ির সিএস ৬৩ দাগের ১০ দশমিক ৭২ একর, ৬৯ দাগের ২৭ দশমিক ৫০ একর, ৭৪ দাগের ২৩ দশমিক ৪০ একর, সেইসাথে ৬৩ দাগের ১০ দশমিক ৭২ একর, ৬৯ দাগের ২৮ দশমিক ও ৭৪ দাগের ২৬ দশমিক ৪১ জমি দখল করেছে বাদশা গ্রুপ। সেই সময় নিম্ন আদালত বাদশা মিয়ার পক্ষে রায় দেয়।


বনবিভাগ মেহেরাবাড়ীর সম্পত্তিতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে জেলা প্রশাসক প্রস্তাব দিয়েছিলো। কিন্তু এই উচ্ছেদ অভিযান এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। মেহেরাবাড়ীর মৌজার জমি উদ্ধারে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ২০১৮ সালে ময়মনসিংহ জেলা যুগ্ম জেলা আদালত-৩-এ  মামলা করেন বাদশা গ্রুপের বিরুদ্ধে। মামলা সূত্রে জানা যায়, ভালুকা উপজেলাধীন মেহেরাবাড়ীর মোজার ৬৩,৭৪ ও ৬৯ এই তিনটি দাগে বাদশা গ্রুপের মালিক বাদশা মিয়া ৬১ দশমিক ৫২ শতাংশ জায়গা দখল করে।

সরকারের এসব সম্পত্তি উদ্ধার ও বনভূমিতে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে তৎকালীন ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সাইদুর রশীদ ২০১৮ সাথে জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার ও ভালুকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত চিঠি দিয়ে সহায়তা চেয়েছিলো। দখলকৃত জমিতে যৌথ জরিপ নিষ্পত্তি না হওয়া সকল পক্ষকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে অনুরোধ জানায় বনবিভাগ। কিন্তু সেই সময়কার প্রশাসন বনবিভাগকে কোনরকম সহায়তা করেনি বলে অভিযোগ করেছে বনবিভাগ। ফলে কোনরূপ বাধা ছাড়ায় নির্বিঘ্নে বাদশা গ্রুপ তাদের সাম্রাজ্য অবকাঠামো নির্মাণ কাজ চালিয়ে যায়। বেদখল হতে শুরু করে বনবিভাগের এককের পর একর জমি।

বাদশা গ্রুপের দখল সাম্রাজ্য তৈরিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে বনবিভাগের বিরুদ্ধে। বাদশা গ্রুপ বনবিভাগের কত একর সম্পত্তি দখল করে আছে সেটা নিয়ে লুকোচুরি করছে। বনবিভাগের হিসেব মতে, এই গ্রুপটি দু'দাগে মোট ২০ একর সম্পত্তি দখল করার হিসেব দেখাচ্ছে। কিন্তু এলাকাবাসীর অভিযোগ, বাদশা গ্রুপের সমস্ত সম্পত্তি নাকি বনবিভাগের দখল করা জমি। এটা কোনোভাবেই মাত্র ২০ একর হতে পারে না।

এদিকে, বাদশা গ্রুপ ছাড়াও ভালুকা বনভূমির জমি বেদখলের সঙ্গে জড়িত রয়েছে দেশের নামিদামি শিল্পগোষ্ঠী। ঢাকা ময়মনসিংহ হাইওয়ের ভালুকা অংশের মহাসড়কের যেদিকে চোখ যায় সেদিকে দখলের রাজত্ব। বনের জায়গায় কেউ করেছেন বাড়ি কেউ করেছেন পার্ক ও কলকারখানা। একদিকে বনের জায়গায় কলকারখানা নির্মাণ অন্যদিকে কারখানার বর্জ্য সরাসরি খালের লাইন থাকায় বিপর্যস্ত প্রকৃতি।


এই বিষয়ে কথা বলতে বনবিভাগের ভালুকা রেঞ্জের উপপরিচালক হারুনুর রশীদের দফতরে যায় বার্তা২৪ কম-এর প্রতিবেদক। তবে হারুনুর রশীদ বন বিভাগের কি পরিমাণ জমি বেদখলে আছে- তা জানাতে রাজি হননি।

ভালুকা উপজেলা জবর দখলের মামলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি জানান, তিনি হিসেব করে জানাবেন, এই মুহূর্তে তার মনে নাই।

বাদশা গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাদশা গ্রুপের সব কারখানা বনের জায়গায় দখল করে নির্মাণ করা। বনের জায়গা দখলের জন্য এই গ্রুপের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা রয়েছে। তবে এই মুহূর্তে সংখ্যাটা বলা যাচ্ছে না।’

দখল হওয়া বনের জায়গা উদ্ধারে কি ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে- এমন প্রশ্নের তিনি বলেন, ‘দখল করা জায়গায় স্বয়ং এমপি সাহেব আমাদের ঢুকতে দেননি, গাছও লাগাতে দেয় নি। তাছাড়া সেখানে আমাদের ফরেস্ট অফিস পর্যন্ত নেই।’

বনের জায়গা দখল করে বাদশা গ্রুপের কারখানা নির্মাণের অভিযোগের বিষয়ে জানতে গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাদশা মিয়ার সাথে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে ফোনে মেসেজ পাঠানো হয়। তারও উত্তর দেননি বাদশা মিয়া।

‘পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়া বনের জমি দখল করে কারখানা স্থাপনের সুযোগ নেই’ বলে জানিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

‘বনের জায়গা দখল বা সরকারের খাস জমি দখল করে কলকারখানা স্থাপন করার কোনো সুযোগ নাই। সাধারণত পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো কারখানা করার এখতিয়ার নাই’- সেখানে বাদশ গ্রুপ কিভাবে বনের জায়গা দখল করে কারখানা স্থাপন করে-এই প্রশ্ন তোলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।

'বনের জায়গা দখল নিতে স্থানীয় প্রশাসন, বন বিভাগের কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের নিয়ে একটি চক্র কাজ করে। যার ফলে আইনি প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়ে অপরাধীরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দিকে যায়।'- বলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

‘বনের জায়গা উদ্ধারে কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার ঘাটতি আছে’- বলে জানান ড. ইফতেখারুজ্জামান।

‘বনের জায়গা দখল বন্ধে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা নেওয়ার কথা পরিবেশ অধিদফতরের। কিন্তু তারা যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ। যা বিভিন্ন প্রতিবেদন ও আমাদের গবেষণায় ওঠে এসেছে। বনের জমি দখলকারীরা যে পরিচয়ের হোক- তাদের চিহ্নিত করে জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এখানে আইনের কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলে পরবর্তীতে এই দখল কার্যক্রম বন্ধ হবে।‘- বলেছিলেন তিনি।

দখল ঠেকাতে এখন ‘অপূর্ব সুযোগ’ এখন উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অন্তবর্তীকালীন সরকার যদি ভালুকার বনভূমি উদ্ধারে কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। ফলে শুধু ভালুকা নয় অন্য বনভূমির জমি উদ্ধার সহজ হবে। কারণ এই সরকারের ভয়ের কিছু নাই, তাদের কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নাই-হারাবার কিছু নাই। বর্তমান সরকারের যেহেতু কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নাই, তাই তাদের উচিত হবে দখলদারদের চিহ্নিত করে জবাবদিহিতার মধ্য নিয়ে আসা।’

ভালুকায় বনের জায়গা বেদখল নিয়ে প্রধান বন সংরক্ষক কর্মকর্তা মোঃ আমীর হোসাইন চৌধুরী বার্তা২৪ কমকে বলেন, ভালুকা সম্পত্তি নিয়ে অনেক সমস্যা রয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় মামলা হয়েছে। সেগুলো সমাধান না হলে আমরা কিছু করতে পারছি না।

বনের জমি উদ্ধারের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উচ্ছেদ করার ক্ষমতা আমার নেই। এটি জেলা প্রশাসক, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট করবেন। আমরা যেটা করেছি বনের জায়গা উদ্ধারে সব প্রস্তাব জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে পাঠিয়েছি। নিয়ম হচ্ছে তারা কাগজ পত্রগুলো যাচাই বাছাই করে মামলা রুজু করে উচ্ছেদ করে আমাদের কাছে ফেরত দেবেন।

উচ্ছেদ কার্যক্রমের জটিলতা নিয়ে প্রধান বন সংরক্ষক কর্মকর্তা বলেন, উচ্ছেদের কিছু নিয়ম কানুন আছে। রেকর্ড কার নামে সেটা উনি দেখবেন। উচ্ছেদ করার প্রস্তাব আমি দিলাম কিন্তু রেকর্ড সমস্যা থাকলে উনি আবার উচ্ছেদ করবেন না। জমি-জমার জটিলতা অনেক। একটি মামলা করলে সারাজীবন চলে যাবে এটার আর সমাধান হয় না।

ময়মনসিংহ বন বিভাগের অধীন ভালুকা রেঞ্জ। বনের মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থা ভালুকা রেঞ্জের। এই রেঞ্জের অধীনে থাকা মল্লিকবাড়ি বিট মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। ১৫৯৯ একর জমির মালিক হয়েও মল্লিকবাড়ি বন বিট এখন নিজেই ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে। শুধু ভূমিহীন না বলে বাস্তহারা বললেও ভুল হবে না, কারণ তার নিজের দাঁড়াবার জন্য সামান্য ঠাঁইও নেই। অন্য বিটের অফিসে আশ্রিত হিসেবে রয়েছেন খোদ বিট অফিসার।

ভালুকা রেঞ্জ ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ের পাশে অবস্থিত হওয়ায় জমি সোনার চেয়েও দামি। এক শতাংশ জমির দাম ক্ষেত্র বিশেষে ১০ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত রয়েছে। এখানে জমি জবরদখলে নামিদামি কোম্পানিও পিছপা হয়নি। স্কয়ার, ওরিয়ন, এনভয়, লভেলো আইসক্রিম, লাবিব ডাইং ও ব্র্যাকের মতো জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান বনের জায়গা দখলে রেখেছে। বন বিভাগ মামলা দিয়ে তাদের দায় সেরেছে।