দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রাখার ঘোষণায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে। গত দুই বছরের অভিজ্ঞতা থেকে কেউ বলছেন, শুধু স্কুল-কলেজ বন্ধ নয়, সকল সামাজিক অনুষ্ঠানও বন্ধ করতে হবে। নইলে শিক্ষার্থীরা এই বন্ধের সময় এসব আয়োজনে অংশ নিয়ে সংক্রমিত হবার ঝুঁকিতে পড়বে। আবার কেউ সব কিছু খোলা রেখে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাকে একটি আত্মঘাতী ভুল সিদ্ধান্ত বলছেন।
এদিকে দেশে করোনা শনাক্তের হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত ২৪ ঘণ্টার নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ছিল ৩১ দশমিক ২৯ শতাংশ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের জুন-জুলাই মাসে করোনা শনাক্তের হার ছিল ২০ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে। গত আগস্ট মাসে গড়ে শনাক্তের হার ছিল ২০.১৯ শতাংশ।
রাজধানীর একটি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী বুশরা। তার মা সেলিনা বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমার মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে যখন উঠলো তখনও তেমন পড়ানো সম্ভব হয়নি। করোনার জন্য স্কুল বন্ধ ছিলো। অনলাইনের পড়া আর স্কুলের পড়া কি এক হয়? এতোটুকু বাচ্চা একা একা অনলাইনে কী শিখবে? এখন চতুর্থ শ্রেণিতে উঠলো। আবার স্কুল বন্ধ। সামনে যে কী আছে সেটাই ভাবছি।
মানিকগঞ্জের খানবাহাদুর আওলাদ হোসেন খান কলেজের সহকারী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু বার্তা২৪.কমকে বলেন, সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত আমার কাছে যথার্থই মনে হয়েছে। তবে শুধু স্কুল-কলেজ বন্ধ রেখেই শিক্ষার্থীদের নিরাপদে রাখা যাবে না। বন্ধের সুফল পেতে হলে একইসাথে মেলা, বিয়ে-শাদি, সামাজিক- সাংস্কৃতিক,ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতেও কঠোরতা আরোপ করতে হবে। নইলে শিক্ষার্থীরা এই বন্ধের সময় এসব আয়োজনে অংশ নিতে গিয়ে সংক্রমিত হবার ঝুঁকিতে পড়বে।
প্রাথমিকের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জসিম বার্তা২৪.কমকে বলেন, সব কিছু খোলা রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা কোনো সমাধান নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ রাখার ফলে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি মেধাহীন প্রজন্ম পাবো যার ফলে আমাদের দীর্ঘদিন কুফল ভোগ করতে হবে। দুই বছর আগে যে বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল অ আ ক খ শেখার জন্য সেই বাচ্চাটি কিন্তু পুরোপুরি তার মেধার বিকাশ ঘটা ছাড়াই উপরের ক্লাসে উঠিয়ে দিতে হচ্ছে। আবার যারা অষ্টম শ্রেণি কিংবা একাদশ শ্রেণিতে পড়তো তাদেরকে ও অটো পাশের মাধ্যমে পরবর্তী ক্লাসে উঠিয়ে দেওয়ার ফলে মেধাহীন প্রজন্মের জন্য অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়।
রাজধানীর মাটিকাটার স্কাইলার্স মডেল স্কুলের প্রিন্সিপাল সাফায়েত হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, সব কিছু খোলা রেখে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে করোনাভাইরাস সংক্রমণ কমানোর চিন্তা মানে আমি মনে করি একটি আত্মঘাতী ভুল সিদ্ধান্ত। একটা জাতিকে ধংস করার জন্য এটম বোমা হামলার দরকার নেই তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধংস করাই যথেষ্ট। আজ আমরা সেই দিকে ধাবিত হচ্ছি।
২০২০ সালের মার্চে বাংলাদেশে প্রথম করোনা মহামারি দেখা দেয়ার পর ১৮ মার্চ থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে ছুটি বাড়তে থাকে।
সর্বশেষ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় গত ১৩ জানুয়ারি থেকে ১১টি বিধিনিষেধ দিয়েছে সরকার। এরপরও ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণে প্রভাব না পড়ায় গত ২১ জানুয়ারি থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়াসহ নতুন করে ৬টি নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সমাবেশ ও অনুষ্ঠানে ১০০ জনের বেশি মানুষের সমাবেশ করা যাবে না।
এছাড়া আজ সোমবার থেকে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্ধেক জনবল নিয়ে চল অফিস। গতকাল রবিবার সরকারি-বেসরকারি অফিসের ক্ষেত্রে নতুন নির্দেশনা জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে জানা যায়, গত মার্চ মাস পর্যন্ত টানা এক বছর পৃথিবীজুড়ে প্রায় ১৭ কোটি শিক্ষার্থী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১০ কোটি শিশুই ছিল ১৪টি দেশের, যেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এমন অবস্থায় শিক্ষার্থীদের ক্লাসে পাঠাতে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে করোনায় গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১০ হাজার ৯০৬ জন নতুনভাবে শনাক্ত হয়েছে এবং শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ২৯ শতাংশ এসে দাঁড়িয়েছে। এ হার গত ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর আগে গত বছরের ২২ জুলাই সর্বোচ্চ শনাক্ত হয়। সেদিন প্রতি ১০০টি নমুনা পরীক্ষায় ৩২ দশমিক ১৮টিতে কভিড পজেটিভ আসে।
এর আগের দিন গত শনিবার নতুন রোগী ছিল ৯ হাজার ৬১৪ জন। সেদিন নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল ২৮ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ একদিনেই রোগী বেড়েছে ১ হাজার ২৯২ জন; যা গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত হার। গত ২৪ ঘণ্টায় (শনিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল রবিবার সকাল ৮টা) পর্যন্ত করোনায় আরও ১৪ জন মারা গেছেন। এর আগের দিন মারা গেছেন ১৭ জন।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেন, বর্তমানে ঢাকায় করোনাভাইরাস আক্রান্তদের ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ এ ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনে সংক্রমিত। ঢাকার বাইরেও ওমিক্রনের সংক্রমণ বাড়ছে। ওমিক্রন ভীষণ ছোঁয়াচে। এটি দ্রুত ছড়ায়। এ কারণেই নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার বেড়ে গেছে।